রবিবার, ২২ জুন, ২০১৪ ০০:০০ টা
এনামুল হক শামীমের ওপর সন্ত্রাসী হামলা

ছয় সেকেন্ডে তিন গুলি

ছয় সেকেন্ডে তিন গুলি

সকাল ৯টা ২৮ মিনিট ১৮ সেকেন্ড। ধানমন্ডি ১০/এ থেকে জিগাতলামুখী ব্যস্ত সাতমসজিদ সড়ক। অনেক যানবাহনের মধ্যে একটি কালো রংয়ের পাজেরো। এর ঠিক পেছনেই তিন আরোহীর একটি লাল রংয়ের মোটরসাইকেল। ৯টা ২৮ মিনিট ২২ সেকেন্ড। ধানমন্ডি ৯/এ-সড়ক, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিকের ঠিক সামনের জেব্রা ক্রসিং। দুটি সাদা রংয়ের প্রাইভেট কার, দুটি হিউম্যানহলার ও ছয়-সাতটি রিকশার পেছনঘেঁষে ছয়-সাত জন পথচারী ওই জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। এ সুযোগটি লুফে নিয়ে কম গতিতে থাকা জিগাতলামুখী কালো পাজেরোটির বাম পাশ দিয়ে খুব কাছঘেঁষে সেই মোটরসাইকেলটি। চোখের পলকেই মোটরসাইকেলটির আরোহীবেশী দুই ঘাতক অস্ত্র বের করে খুব কাছ থেকে পরপর তিন রাউন্ড গুলি করে পাজেরোর চালকের পাশে বসে থাকা ব্যক্তিটিকে। ২২ থেকে ২৮। মাত্র ছয় সেকেন্ডের মধ্যেই ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে নুইয়ে পড়েন টার্গেটকৃত ব্যক্তিটি। ঘাতকের প্রাণঘাতী আরও বুলেট থেকে মালিককে বাঁচাতে চালক মুহূর্তেই ইউটার্ন করে গাড়ি নিয়ে টান দেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের দিকে। হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য দেখে এবং গুলির বিকট আওয়াজে থমকে যান রাস্তা পার হওয়া পথচারীরা এবং আশপাশ ভবনের সামনে থাকা কর্মব্যস্ত মানুষ। কিছু সময়ের জন্য ফাঁকা হয়ে যায় ব্যস্ত সাতমসজিদ সড়ক। টার্গেটকৃত ব্যক্তিটি ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম এনামুল হক শামীম। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সংগৃহীত চারটি ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে এসব বিষয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনামুল হক শামীমের ধানমন্ডি ১০/এ সড়কের ৪৬ নম্বর বাড়ি থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব মাত্র ৫০০ গজ। হামলাকারীরা আগে থেকেই তার বাসার আশপাশে ওতপেতে ছিল এবং ওই পাজেরোটি অনুসরণ করে আসছিল। এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, কেবল ওই মোটরসাইকেল নয়, এ অপারেশনের ব্যাকআপ (সাপোর্ট) হিসেবে আরও অনেকেই হয়তো ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিল। উল্টো দিকের রাস্তায় প্রচুর গাড়ি থাকায় কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি না নিয়ে ঘাতক দল সোজা জিগাতলার দিকে চলে যায় বলে দেখা গেছে একটি ভিডিও ফুটেজে। তবে ঘটনাস্থল থেকে কিছু দূর এগিয়েই একটি গলিতে ঢুকে নিরাপদ গন্তব্যে ঘাতকরা চলে যায় বলে নিশ্চিত করেছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, মোটরসাইকেলের চালক (সাদা হেলমেট) এবং সবার পেছনে (কালো হেলমেট) বসা একজন- এর মাঝখানে বসা অন্য ব্যক্তির মাথায় কোনো হেলমেট ছিল না। তিনিই প্রথমে অস্ত্র বের করে গুলি ছোড়েন। ঘাতক দলের মোটরসাইকেলটির পেছনে সাদা রংয়ের একটি প্রাইভেট কার ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হামলার সম্ভাব্য কয়েকটি কারণের মধ্যে শরীয়তপুরের উপজেলা নির্বাচনকে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করছেন গোয়েন্দারা। এ বিষয়টিকেই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন শামীমের পরিবারের সদস্যরা। এ ছাড়া হামলার ঘটনায় শুক্রবার রাতে শামীমের চাচা নাসির উদ্দীন অজ্ঞাত আসামি উল্লেখ করে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করেছেন। নম্বর-১৭। এনামুল হক শামীমের ছোটভাই আশরাফুল হক সিয়াম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গুলিবিদ্ধ হাতের ইনফেকশন ঠেকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। ইতিমধ্যে একটি বোর্ড গঠন করেছেন তারা। চিকিৎসকরা বলেছেন তারা অনেক আশাবাদী। হামলার ঘটনায় কারা জড়িত থাকতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভাইয়ার কোনো শত্র“ আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। তবে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচন ঘিরে কিছু লোকের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এর বাইরে জামায়াত-বিএনপির লোকজনও তার ওপর হামলা চালাতে পারে বলে আমরা মনে করছি। তবে আমাদের একটাই কথাÑ ঘাতকদল ও তাদের নেপথ্য মদদদাতারা শনাক্ত হোক। তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হোক।’ র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে র‌্যাব। হামলাকারীদের খুঁজে বের করার জন্য সর্বাÍক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফুটেজে হামলাকারীদের চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। তবে কালো রংয়ের মোটরসাইকেলটিতে তিন আরোহীর দুজনের মাথায় হেলমেট ছিল এবং দুজন পরপর গুলি করছিল। দিনদুপুরে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে চলন্ত গাড়িতে গুলি করা যেনতেন অপরাধীর কাজ নয়। চলন্ত যানবাহন থেকে নিশানা ঠিক রাখাটা কঠিন কাজ। তিনি আরও বলেন, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়গুলোয়ও যদি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো যায় তাহলে অপরাধ অনেক নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাসিরউদ্দিন খান জানান, মোটরসাইকেলের নম্বরটি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে ফুটেজটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীসহ আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ থেকে পাওয়া আরও কিছু তথ্যের ভিত্তিতে হামলাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডি ১০/এ রোডের বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার পথে সাতমসজিদ রোডের ৯/এ সড়কের কাছে পৌঁছালে এনামুল হক শামীম হামলার শিকার হন। এ সময় একটি চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত খুব কাছ থেকে পরপর তিন রাউন্ড গুলি চালায়। দুটি গুলি গ্লাস ভেঙে শামীমের বাম হাতে বিদ্ধ হয়। এর মধ্যে একটি গুলি হাত ভেদ করে তার বুকের কাছ দিয়ে যায়। শামীমকে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সব শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর