রবিবার, ২২ জুন, ২০১৪ ০০:০০ টা

অরক্ষিত বন্দর সুরক্ষিত দুর্বৃত্ত চক্র

নজরদারির বাইরে হাজার কোটি টাকার পণ্য

অরক্ষিত বন্দর সুরক্ষিত দুর্বৃত্ত চক্র

দুর্বল ব্যবস্থাপনায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এই বন্দরের নিরাপত্তায় নেই কোনো টহলের ব্যবস্থা। বছরের পর বছর নজরদারির বাইরে থাকছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার আমদানি পণ্য। যখন তখন বহিরাগতরা ঢুকে পড়ছে বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায়। রাতের আঁধারে কনটেইনার ভেঙে দুর্বৃত্তরা লুটে নিচ্ছে বিভিন্ন মালামাল। আমদানি করা কোটি টাকার ফেব্রিক্স এই বন্দরেই হয়ে যাচ্ছে মাটি। বন্দরে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা নতুন গাড়ির গ্লাস নেই। কোনো গাড়ির পার্টসও খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। কনটেইনারশুদ্ধ হাওয়া হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে দেশের সর্ববৃহৎ এই নৌ-বন্দরে। গত মাসে সরেজমিন অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম বন্দরের ভঙ্গুর নিরাপত্তা ব্যবস্থার এমন চিত্র উঠে এসেছে। এসব ঘটনায় জড়িতরা চিহ্নিত হলেও থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অরক্ষিত বন্দরে দীর্ঘদিন ধরেই সুরক্ষিত থাকছে দুর্বৃত্তচক্র। জানা যায়, বার বার চুরি ও লুটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, বহির্বিশ্বে ক্ষুণ্ন হচ্ছে বন্দরের সুনাম। পণ্য চুরি বা হারানোর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণও। গত সাড়ে পাঁচ মাসে ১৭টি বড় ধরনের চুরি হয়েছে বন্দরের ভেতরে। এ অবস্থায় নিরাপত্তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা ভীষণ চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতিটি ফটক গলিয়ে বহিরাগতরা ঢুকে পড়ছে। অনেকে ঢুকছে মোটরসাইকেল নিয়ে। নিরাপত্তা কর্মীর যোগসাজশে গাড়ি নিয়েও ঢুকে পড়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। এরাই বন্দরের ভেতর নানা অপরাধে জড়িত বলে জানা গেছে। মাত্র ১২৬টি ক্যামেরা দিয়ে বন্দরের ৩০ ভাগ এলাকায় নজরদারি করা হচ্ছে। বাকি ৭০ ভাগ অংশে সিসিটিভি নেই। যেখানে ৪ হাজার কোটি টাকার মাল রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য থাকে সিসিটিভির নজরদারির বাইরে।

২০০৮ সালে গৃহীত হয় ৩০০ সিসিটিভি কেনার ৩১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। কিন্তু ওই প্রকল্প ৬ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। সম্প্রতি পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সভায় বন্দর ব্যবহারকারীরা পণ্য চুরি ঠেকাতে সিসিটিভির সংখ্যা বাড়ানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু এ অনুরোধের পর দুদিনের মাথায় বন্দর ইয়ার্ডে বড় ধরনের চুরির ঘটনা ঘটে। গত ১২ মে বন্দরের অত্যন্ত সুরক্ষিত জেআর ইয়ার্ড থেকে চীন থেকে আমদানিকৃত ৮০ লাখ টাকার কাপড় চুরি হয়ে যায়। সংঘবদ্ধচক্র রাতের আঁধারে এসব কাপড় চুরি করে। সম্প্রতি বুয়েটের একটি টিম প্রাথমিক রিপোর্টে বন্দরের নিরাপত্তা জোরদারে ৮০০ সিসিটিভির প্রয়োজন বলে জানিয়েছে। কিন্তু কবে বাড়তি সিসিটিভি কেনা হবে এবং নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন করা হবে তা কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর চলছে ১৯৪৮ সালের নিরাপত্তা ছকে। অথচ গত কয়েক বছরে আমদানি-রপ্তানির এ গেটওয়েতে স্থাপনা বেড়েছে ২০ গুণ, কার্যক্রম বেড়েছে ১০০ গুণেরও বেশি। তখন যে বন্দরটি মাত্র ১০ হাজার বাল্ক কার্গো হ্যান্ডেল করত, এখন সেই বন্দর বছরে হ্যান্ডলিং করছে ১১ লাখ টিইইউএস কনটেইনার। কিন্তু ক্রমবর্ধমান এ সক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি নিরাপত্তা রক্ষী। নিরাপত্তা বহরে যুক্ত হয়নি আধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম। গেটে নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা শত কোটি টাকার পণ্যবাহী একটি গাড়ি তল্লাশিতে সময় পান মাত্র আড়াই মিনিট। এ সুযোগে নিষিদ্ধ পণ্যও নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে সংঘবদ্ধ চোরচক্র। সংরক্ষিত এলাকার ৩৮৮টি পয়েন্টে কমপক্ষে ১ হাজার ৩৬৪ জন নিরাপত্তা কর্মীর প্রয়োজন। কিন্তু কর্মরত আছে এর এক-তৃতীয়াংশ। এদের মধ্যে আবার ৮০ শতাংশের বয়স ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কার্যক্রম যে হারে বেড়েছে সে হারে নিরাপত্তা বলয় সুরক্ষিত হয়নি। এক বছর আগে ১ হাজার ১৬৫ জন লোকবলের একটি তালিকা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এখনো তা পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি স্থাপিত টু-স্টেজ গেটের রাস্তার নিচে শক্তিশালী ক্যামেরা সেট করা হয়েছে। গাড়ির নিচের অংশে কেউ কোনো অবৈধ জিনিস নিলে তা শনাক্ত করছে এ ক্যামেরা। এ ছাড়া সিটিএমএস কার্যকর হওয়ায় নিরাপত্তা বেড়েছে। সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে ৩০০ সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে একবার টেন্ডারও আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ওই টেন্ডার বাতিল করে দেয়। মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে। নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ে নতুন প্রস্তাবনা পাঠায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সে প্রস্তাব এখনো আলোর মুখ দেখেনি। অথচ পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকায় বন্দরের সংরক্ষিত এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত চুরি হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি পণ্য। ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় ২৭টি চুরির ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালে ঘটে ৩১টি। ২০১৩ সালে ৩০টিরও বেশি চুরির ঘটনা ঘটে। আর চলতি বছরের সাড়ে পাঁচ মাসে ১৭টিরও বেশি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ইয়ার্ডে নজরদারি বাড়াতে সিসিটিভির সংখ্যা বাড়ানো জরুরি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (নিরাপত্তা) লে. কর্নেল মোয়াজ্জেম হোসেন। বুয়েট চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি। প্রতিবেদন মনমতো হলেই পদক্ষেপ নেব। তবে বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় কোনো অঘটন ঘটেনি। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দরের উপপরিচালক (নিরাপত্তা) লে. কমান্ডার নিজাম উদ্দিন জানান, বন্দরে যা সিসিটিভি ক্যামেরা আছে তা দিয়ে ইয়ার্ডের মাত্র ৩০ ভাগ পর্যবেক্ষণ করা যায়। বাকি ৭০ ভাগ থাকে ক্যামেরার আওতার বাইরে। চুরি ঠেকাতে সংরক্ষিত এলাকার শতভাগ সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনালের এক কর্মকর্তা জানান, বন্দরে সব সময় ২৪ থেকে ২৫ হাজার কন্টেইনার (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের) থাকে। এর মধ্যে ২ থেকে ৩ হাজার কন্টেইনার থাকে খালি। বাকি সব কন্টেইনারেই থাকে আমদানি-রপ্তানি পণ্য। প্রতিটি কন্টেইনারে গড়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার পণ্য থাকে। সেই হিসাবে সিসিটিভির আওতার বাইরে ৭০ ভাগ এলাকায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য থাকে।

কনটেইনারে বালু মাটি : ২০০৭ সালে ফোর এইচ গ্রুপের আমদানি করা পণ্য ভর্তি কনটেইনার থেকে চুরি হয়ে যায় কোটি টাকার ফেব্রিক্স। কনটেইনার খুলে পণ্য নিতে গিয়ে দেখা যায় কনটেইনারের ভেতর প্রচুর বালু ও মাটি। এ ঘটনায় বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গঠন করে তদন্ত কমিটি। সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখনো আলোর মুখ দেখেনি। প্রতিষ্ঠানটি এখনো চুরি যাওয়া ফেব্রিক্স পায়নি। কোনা ধরনের ক্ষতিপূরণও পায়নি।

চুরি চলছেই : নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও বন্দর ইয়ার্ডে থামেনি চুরি। ইয়ার্ডে কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা ২৫ হাজার থেকে ৩৭ হাজারে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি চুরির প্রবণতা। গত ১২ মে বন্দরের নিরাপত্তা হেফাজত থেকে প্রায় ৮০ লাখ টাকার আমদানি করা কাপড় চুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বন্দর থানায় মামলা হলে ২ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

মাসে ১০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ চুরি : চট্টগ্রাম বন্দরের শেডে রাখা গাড়ি থেকে যন্ত্রাংশ ও তেল চুরি হচ্ছে অহরহ। প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে এই শেড থেকে। সম্প্রতি এক রাতে ৬টি গাড়ি চুরি হয়ে গেছে। এর সঙ্গে জড়িত বন্দরের কিছু নিরাপত্তা কর্মী। তেল চুরির সময় একটি রিকন্ডিশন গাড়িও পুড়ে যায়।

বন্দর চেয়ারম্যানকে চিঠি : চুরি প্রতিরোধে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানকে লিখিত অনুরোধ করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিএমসিসিআই)। লিখিত অনুরোধে সিএমসিসিআই-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এ এম মাহবুব চৌধুরী বলেন, বন্দরে জাহাজ ভিড়ার পর থেকে পণ্য ডেলিভারি পর্যন্ত এফসিএল কন্টেইনার বা শেড থেকে ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় মালামাল চুরি হচ্ছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতে যে পয়েন্টে কাভার্ড ভ্যান লোড হবে সেই পয়েন্ট থেকে বিশেষ সিল করা ব্যতীত কোনো কাভার্ড ভ্যান মালামাল নিয়ে বের হবে না। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে মালামাল চুরি বন্ধ হবে।

 

 

সর্বশেষ খবর