প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘যারা ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছেন, এতিমের টাকা পর্যন্ত মেরে খেয়েছেন তাদের গলায় এখন বড় আওয়াজ শুনি! আর তার বিরুদ্ধে মামলা হলেই আমাদের দোষ। উনি যদি এতিমের টাকা মেরে না-ই খাবেন, তবে আদালত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? সাহস থাকলে মামলা মোকাবিলা করে প্রমাণ করুন, আপনি এতিমের টাকা মেরে খাননি।’
গতকাল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সূচনা বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, সভায় সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক, জাতীয় সম্মেলন, সংগঠনকে শক্তিশালী করা, প্রতিপক্ষের আন্দোলনসহ সার্বিক পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়াও ডিসেম্বরের মধ্যেই জেলা সম্মেলন শেষ করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বিএনপি জোটের আন্দোলন মোকাবিলায় নতুন করে সাংগঠনিক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে বলে সূত্র জানায়। জানুয়ারিতে দলের জাতীয় কমিটির সভা ডাকার বিষয়টিও সভায় আলোচনা হয়। এ ছাড়া বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের কর্মসূচি নিয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়। ‘কথিত’ কিছু সুশীল সমাজের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আকাশে-বাতাসে, পত্রিকার পাতায় দেশের উন্নয়নে অনেকের অনেক থিওরি (তত্ত্ব) শুনি। কিন্তু উনাদের দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক থিওরি ডুবে গেছে। আমি অত শত থিওরি বুঝি না। আমি একটাই থিওরি বুঝি- কীভাবে সব মানুষের অন্ন, চিকিৎসা, বাসস্থান ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করব। এই থিওরি নিয়ে আমি দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। কেউ এই অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি আমাদের দুর্নীতি তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। আমার বিরুদ্ধে ১০-১২টি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেও আমাদের দুর্নীতি খুঁজেছে, তারাও আমার বিরুদ্ধে চার-পাঁচটি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতির অজুহাত তুলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে পরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও দুর্নীতির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও বিশ্বব্যাংক আমাদের দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। কিন্তু যারা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন, দুর্নীতি করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন, বিদেশে পাচার করেছেন সেই বিএনপির নেত্রী এখন আমাদের দুর্নীতি খুঁজে বেড়ান।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে দেশকে ফেইল (ব্যর্থ) রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। কারণ এরা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যাতে কোনো দিন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারে, সারা জীবন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে চলতে হয়- পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সে চেষ্টাই করে গেছে। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা বীরের জাতি। আমরা চাই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে চলবে, আত্মনির্ভরশীল হবে, বিশ্বের বুকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হবে। আমরা এ লক্ষ্য নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে একমাত্র আওয়ামী লীগই যে দেশকে সব দিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তা আমরা প্রমাণ করেছি। ইনশা আল্লাহ এই অগ্রযাত্রা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।’ বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এরা ক্ষমতায় থেকে দেশের কোনো উন্নয়ন করেনি। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছে। ধর্মের নামে রাজনীতি করলেও এরা জাতীয় মসজিদে আগুন দিয়েছে, শত শত কোরআন শরিফ পুড়িয়ে দিয়েছে। মসজিদে কোরআন শরিফ পড়া অবস্থায় আমাদের এক কৃষক লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে তারা।’ তিনি প্রশ্ন করেন, যারা ধর্মের নাম নিয়ে কোরআন শরিফ পোড়াতে পারে, তারা কি আদৌ মুসলমান? খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ না করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাকে মামলা মোকাবিলা করতে যাতে না পারি, সেজন্য দেশে ঢুকতে বাধা দিয়েছে। আমি জোর করে দেশে ফিরে মামলা মোকাবিলা করেছি। উনারও যদি সাহস থাকে যে তিনি এতিমের টাকা মেরে খাননি, তবে আদালতে গিয়ে মামলা মোকাবিলা করুক। এতিমের টাকা মেরে খেয়ে এখন পালিয়ে বেড়ান, আবার আমাদের দুর্নীতি খোঁজেন! আসলে উনার (খালেদা জিয়া) অবস্থা হয়েছে ‘চোরের মার বড় গলা’ প্রবাদের মতোই।” সারা দেশে কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশে ওয়ার্ড, থানা, উপজেলা ও জেলার সম্মেলন চলছে। অনেক জেলার সম্মেলন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সব সহযোগী সংগঠনেরও সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছে। আর এই সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গঠন প্রক্রিয়ায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্ততায় অংশ নিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা-বিশ্বাস থেকেই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। কারণ তাদের বিশ্বাস ও আস্থা আছে যে, একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে দেশের সার্বিক উন্নয়ন করতে, দেশকে এগিয়ে নিতে। মাত্র পাঁচ বছরেই সারা দেশের অবিশ্বাস্য উন্নয়নে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যার জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশ বাংলাদেশের প্রশংসা করছে, উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দেখছে। তাই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবই।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সূচনা বক্তব্যের পর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এরপর স্বাগত বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সভায় দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়াও ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবস, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস এবং ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের দলীয় কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়।