৩০ বছর ধরে চলে আসা বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে আবারও ব্যর্থ হয়েছে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক। ভারত-পাকিস্তানের সেই একই ধরনের অনাস্থা ও বিরোধই বড় বাধা হয়ে থাকল সার্কের সফলতায়। আশা-জাগানিয়া মোদি ম্যাজিকও দেখা গেল না। প্রতিবারের মতোই আবারও সার্ক কার্যকরে নেতারা একমত হয়েছেন; কিন্তু সম্মত হতে পারেননি বহুল প্রত্যাশিত আঞ্চলিক যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটি স্থাপনে। বরং সার্কে ভারতের আধিপত্য রুখে দিতে চীনকে সদস্য বানানোর বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে পাকিস্তান। তাতে স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট ভারত। এমন পরিস্থিতিতে কাঠমান্ডু ঘোষণায় প্রত্যাশার কথা বলা হলেও তা নিয়ে আশাবাদী নয় বিশ্লেষকরা।
কূটনৈতিক সূত্র মতে, গত দুই মাসে ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত সংঘর্ষই নেপালে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। তখনই সার্কের প্রত্যাশার বাতি নিভে এসেছে। এ বিষয়ে প্রত্যাশা কমে এসেছে। তারপরও যেহেতু আট দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব একসঙ্গে বসবেন তাই শেষপর্যন্ত প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সার্কের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর পরই দেখা গেল ভিন্ন পরিস্থিতি। সার্কে যে তিন চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে প্রত্যাশা ছড়ানো হলো তাতে প্রস্তুতিই নেই বেশির ভাগ দেশের। তাই শুরুতে বাদ পড়ে গেল কানেক্টিভিটির চুক্তি। পরে বিদ্যুতের চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে জোর করা সম্ভব হয়েছে, কারণ এটি একটি ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো চুক্তি। আঞ্চলিক চুক্তি হলেও এর সফলতা নির্ভর করবে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ওপর। সেই দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা ভারত ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে করেও ফেলেছে। জানা গেল, গত রবিবার ও সোমবার সার্কের পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকের পর পরিস্থিতি এমন হলো নেপালে এসে কোনো চুক্তিই স্বাক্ষর করতে পারছেন না দক্ষিণ এশিয়ার আট শীর্ষ নেতা। প্রস্তাবিত তিন চুক্তিই অনিশ্চিত। এরপর এবারের সম্মেলনে অন্তত একটি চুক্তি হলেও স্বাক্ষরের জন্য জোর তৎপরতা চালান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। সাধারণ সময়ের নির্ধারিত বৈঠক গড়ায় গভীর রাত পর্যন্ত। কূটনৈতিক ভদ্রতাকে ছাড়িয়ে রীতিমতো তর্কাতর্কি ও বিবাদে জড়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সেই বৈঠক। তিক্ততা নিয়েই পরদিন উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ দেন আট দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা। কিন্তু সবাই ভাষণে সার্ককে কার্যকর করার বিষয়ে কথা বলেন। কিন্তু চুক্তি তো দূরের কথা ভারত ও পাকিস্তানের দুই প্রধানমন্ত্রী একে অন্যের দিকে তাকিয়েও দেখেননি। নরেন্দ্র মোদি ও নওয়াজ শরিফ বাকি সব রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করলেও নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক সৌজন্যতাও দেখাননি। নওয়াজ শরিফ যখন ভাষণ দিতে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তখন নিজের ফাইল দেখা নিয়ে ব্যস্ত দেখা গেল নরেন্দ্র মোদিকে। আবার মোদি যখন সামনে দাঁড়িয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলেন নওয়াজ শরিফ। এই তিক্ততার মধ্যে চুক্তির সব আশাই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। নেপালের প্রধানমন্ত্রী চাইছিলেন তার দেশে ভারত-পাকিস্তানের দুই প্রধানমন্ত্রী অন্তত হাত মেলান। এ জন্য রাতে নৈশভোজে চেষ্টাও করেন। কিন্তু হয়নি। সেই হ্যান্ডশেক অবশ্য হয়েছে পরদিন সকালে রিট্রিটে যাওয়ার পর। কারণ সেখানে ছিলই শুধু সাতজন। একসঙ্গে সাতজন দুই ঘণ্টা সময় কাটাতে গিয়ে না তাকিয়ে পারা যায় না। এ জন্যই হয়তো ফিরে এসে মিডিয়ার সামনে হাত মেলালেন মোদি-নওয়াজ। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার মতে, এর ফলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দমবন্ধ আবহাওয়া কিছুটা হালকা হলেও দুই পড়শি দেশের মধ্যে বরফ কিন্তু আদৌ গলল না। বরং এ দিনই কাশ্মীরে সেনা-জঙ্গি সংঘর্ষের পর দিল্লি স্পষ্ট করে দিয়েছে, সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়া বন্ধ না করলে সম্পর্ক সহজ হবে না। অর্থাৎ করমর্দনের পর ভারত-পাকিস্তানের পারস্পরিক বিরোধ কমেছে এমনটা ভাবার কোনো কারণই নেই। অন্যদিকে, রিট্রিট সেশনে বিদ্যুৎ চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনার সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ছাড়া অন্য সব সার্ক নেতা ছিলেন এক পক্ষে। তাদের সবার মত ছিল, চুক্তিটি স্বাক্ষর করা উচিত। না হলে ব্যর্থ হয়ে খালি হাতে ফিরে যাওয়া হবে। সম্মেলনের সব আয়োজন ম্লান হয়ে যাবে। এরপর নওয়াজ শরিফ চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিষয়ে তার দেশের সম্মতির কথা জানান।
তবে, অন্যান্য সার্ক ঘোষণার মতো এবারের কাঠমান্ডু ঘোষণায়ও আশার কথা বলা হয়েছে। এবার ব্যতিক্রম হলো সবাই বুঝতে পেরেছেন সার্ককে কার্যকর করার সময় এসেছে। শীর্ষ সম্মেলনে সার্ক নেতারা তিনদশকের ব্যর্থতার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। তাই আগামী দিনগুলোতে সার্ককে আরও জোরদার, গতিশীল ও দৃশ্যমান করার লক্ষ্যে ৩৬ দফা কাঠমান্ডু ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ঘোষণায় ‘সময়ভিত্তিক’ ও ‘ফলভিত্তিক’ শক্তিশালী সার্ক গড়া, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের ১৭০ কোটি মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সংযোগ (কানেক্টিভিটি) উৎসাহিত করা, অর্থনৈতিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাসহ সার্ক সচিবালয় শক্তিশালীকরণ ও সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নের (এসএইইউ) বিষয়টিকে আশার বাতি হিসেবে দেখছেন কূটনীতিকরা। ঘোষণায় এসএইইউ প্রসঙ্গে পরিকল্পিত উপায়ে ও পর্যায়ক্রমে মুক্তবাণিজ্য এলাকা, কাস্টমস ইউনিয়ন, অভিন্ন বাজার এবং একটি অভিন্ন অর্থনৈতিক ও আর্থিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।