সোমবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

নাশকতা করছে কারা

বিএনপি চেয়ারপারসন ৩ জানুয়ারি রাতে অবরুদ্ধ হওয়ার দুই দিন পর থেকে লাগাতার অবরোধ ও বিচ্ছিন্ন হরতালে বেহাল হয়ে পড়েছে সারা দেশ। ভাড়াটে বোমাবাজ চক্র আর পেট্রলবোমা হয়ে উঠেছে হরতাল-অবরোধের প্রধান হাতিয়ার। পেট্রলবোমায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করাসহ সীমাহীন নৃশংসতায় নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। পেট্রলবোমা হামলায় জড়িত অনেকে গ্রেফতার হলেও এ মারণাস্ত্রটির প্রস্তুতকারী ও সরবরাহকারীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। ফলে পেট্রলবোমা তৈরির পরিমাণ বাড়ছে, বিস্তৃতি ঘটছে সরবরাহ স্থানেরও।
লাগাতার অবরোধ বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের অবস্থান না থাকলেও সক্রিয় রয়েছে ভাড়াটে বোমাবাজ চক্র। ভাড়াটে দুর্বৃত্তরাই রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে নাশকতায় মেতে উঠছে। নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেও বোমাবাজ-দুর্বৃত্তরা রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙচুর চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। চোরাগোপ্তা জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, এদের দাপটে পুলিশ-গোয়েন্দারাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির আগেই নেতা-কর্মীরা ধর-পাকড় এড়াতে মহল্লা ছেড়ে এমনকি অনেকে রাজধানীর বাইরে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু এলাকায় সরব থাকার বিষয়টি প্রমাণ করতেই তারা ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের মাঠে নামানোর কৌশল নেন। তবে অধিকাংশ ঘটনা ভাড়াটে চক্রের সদস্যরা ঘটালেও মামলায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাই আসামি হচ্ছেন। হরতাল-অবরোধ বৃদ্ধি পাওয়ায় বোমাবাজদের কদরও বেড়ে গেছে, বেড়েছে রেটও। সবচেয়ে বেশি কদর রয়েছে পেট্রলবোমার। হরতাল-অবরোধে ককটেল, গুলি, বোমার পাশাপাশি ভয়ানক মারণাস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘পেট্রলবোমা’। বানাতে সহজ ও উপকরণগুলো সর্বত্র পাওয়ায় পেট্রলবোমা উঠে এসেছে দুর্বৃত্তদের হাতে হাতে। এ পেট্রলবোমার বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। বাস-মিনিবাস, দোকান-প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হয় মুহূর্তেই। পেট্রলবোমার প্রতি নাশকতাকারীদের ঝোঁক অনেক বেশি। গাড়িচালক ও যাত্রীদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক এখন ‘পেট্রলবোমা’। যানবাহনে আগুন দিতে পিকেটাররাও এটা ব্যবহার করছে। গত ১৩ দিনের টানা অবরোধ ও বিচ্ছিন্ন হরতালে শুধু পেট্রলবোমার আঘাতে ও বিস্ফোরণজনিত আগুনে পুড়ে মারা গেছেন অন্তত ১৬ জন, আহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। পেট্রলবোমায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩ শতাধিক গাড়ি। রাজধানীসহ সারা দেশে অন্তত দুই হাজার পেট্রলবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ককটেলের চেয়ে পেট্রলবোমা তৈরি সহজ হওয়ায় এর ব্যবহার বাড়ছে। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটলে প্রচণ্ড শব্দ হয়। এতে ধরা পড়ার ভয় থাকে। কিন্তু পেট্রলবোমা ছুড়লে সে আশঙ্কা থাকে না। বোতল ভাঙার শব্দ ছাড়া তেমন শব্দ হয় না। তাই পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান,  ২০১৩ সালের শেষের দিকে হরতাল-অবরোধে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররাই সর্বাধিক পেট্রলবোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। টানা দুই মাসের অরাজকতায় তারা ১০ হাজারেরও বেশি পেট্রলবোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে অন্তত ৬৩ জন মানুষ প্রাণ হারান। পুড়ে যায় চার শতাধিক যানবাহন ও পাঁচ শতাধিক স্থাপনা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাত্র ১০-১২ হাজার টাকা পেলেই সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা বাস-মিনিবাস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে  দেয়। আবার বাস-মিনিবাস ভাঙার জন্য তাদের দাবি থাকে পাঁচ হাজার টাকা। যে কোনো জনাকীর্ণ স্থানে, ব্যস্ততম মার্কেটের সামনে, রাস্তার মোড়ে ককটেল-বোমা ফাটানোর জন্য দিতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। টাকা পেলেই তাণ্ডব চালায় রাজপথে, ছড়িয়ে দেয় আতঙ্ক। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছে তারা ‘গাড়ি ভাঙা গ্রুপ’ হিসেবে পরিচিত। রাজধানীসহ আশপাশের বিভিন্ন পয়েন্টে অন্তত ২০টি ভাড়াটে চক্র রয়েছে। প্রতি গ্রুপে আছে ১০-১২ জন করে টোকাই শ্রেণির ভাসমান গোছের বেকার। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অরাজকতায় গাড়ি পোড়ানোর সময় গুলশান লিংক রোড থেকে রফিকুল ইসলাম (৩০) নামে সংঘবদ্ধ চক্রের এক সদস্যকে আটক করে র‌্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে রফিকুল জানায়, তার নেতৃত্বে একটি পেশাদার চক্র মহাখালী কাঁচাবাজার এবং গুলশানের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি পোড়ানোর মিশন চালিয়ে থাকে। তারা পেট্রল ও ম্যাচ নিয়ে টার্গেটকৃত স্থানগুলোতে অবস্থান নেয় এবং সুযোগ মতো বাস-মিনিবাসে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। র‌্যাব-১ এর মেজর এস এম মহিউদ্দিন ওই সময় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রফিকুলের নেতৃত্বে বিভিন্ন বস্তিতে ১৫-২০ জন টোকাই শ্রেণির সদস্য রয়েছে।
জানা যায়, রাজধানীর মতিঝিল, জসীমউদ্দীন রোড, কমলাপুর স্টেশনের আশপাশ এলাকায় হরতাল-অবরোধে নাশকতা চালায় কামরুল-মাসুম-মিঠু গ্রুপ। শাহজাহানপুর রেলক্রসিং থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত এবং খিলগাঁও ও সবুজবাগের বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডব চালায় সোর্স আজিজ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। রামপুরা ব্রিজ থেকে কুড়িল পর্যন্ত ফর্মা আব্বাস ও শাহজাহানের নেতৃত্বাধীন তিনটি গ্রুপ। সাততলা বস্তি এলাকায় বোমাবাজ-দুর্বৃত্তদের নেতৃত্ব দেয় কুলু হানিফ ও ইকবাল। পুরান ঢাকার একটি ভাড়াটে চক্রের নাম রুবেল-আজিজ গ্রুপ। আজিজ-রুবেল গ্রুপটি কোর্টকাচারি এলাকা, জনসন রোড, ধোলাইখাল, ইংলিশ রোড, নবাবপুর রোড, দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা ব্রিজ পর্যন্ত ত্রাস সৃষ্টি করে থাকে। গুলিস্তানে জ্বালাও-পোড়াওয়ের জন্য একাধিক গ্রুপ থাকলেও আক্তার, ব্যঙ্গা, টুন্ডা সোহেল, মিন্টুর নাম উল্লেখযোগ্য। ব্যঙ্গা-টুন্ডার গ্রুপ ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল থেকে গুলিস্তান ট্রাফিক পয়েন্ট, সিদ্দিকবাজার নর্থ-সাউথ রোড এলাকায় অরাজকতা চালায়। যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় জ্বালাও-পোড়াও সিন্ডিকেট দুটি ভাগে বিভক্ত। এর একটি হচ্ছে উত্তর যাত্রাবাড়ী, অন্যটি দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী গ্রুপ। দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী গ্রুপে রয়েছে কসাই শহীদ, বেলাল, সোহাগ, ইদ্রিস, মাহবুব ও ইকবাল। উত্তর যাত্রাবাড়ী গ্রুপে আছে পোড়া সেন্টু, টুন্ডা বাবুল, সালাহউদ্দিন, স্বপন, মিজান, কালা শফিকসহ ২৫-৩০ জন। যাত্রাবাড়ীর কয়েকজন পেট্রল-ডিজেলের ব্যবসায়ী ‘পেট্রলবোমার রসদ’ যুগিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ধোলাইপাড়ে ব্যবসায়ী মনির এবং সায়েদাবাদের সুতিখালপাড় বউ বাজারের আরেক ডিজেল-পেট্রল ব্যবসায়ী খোলা পেট্রল বিক্রি করে থাকেন।
জানা যায়, ঢাকার বাইরের চক্রগুলোই রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি তাণ্ডবলীলা চালিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে টঙ্গীর এরশাদনগর বস্তি ও আরিচনগর এলাকায় অন্তত পাঁচটি ‘ভাড়াটে গাড়ি ভাঙা’ গ্রুপ রয়েছে। এর আগে টঙ্গী পুলিশের হাতে বিল্লাল কালু ও টোকাই ফারুক গ্রেফতার হলে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য ফাঁস হয়। দুজনেই জানায়, তারা ছিনতাই বা ডাকাতির মতো কোনো অপরাধ করে না, শুধু হরতাল, অবরোধের সময় গাড়ি ভাঙা ও পোড়ানোর কাজে লিপ্ত থাকে। আরিচপুরে আরেকটি গ্রুপ গাড়ি ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওয়ের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। তারা ভাড়াটে হিসেবে তেজগাঁও, গুলশান, মহাখালী, বাড্ডায় গাড়ি ভাঙচুরসহ জ্বালাও-পোড়াও করে থাকে। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, রাজধানীতে শতাধিক গ্রুপ পেট্রলবোমা তৈরি ও সরবরাহের কাজে লিপ্ত রয়েছে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তালিকায় পেট্রলবোমা তৈরি ও বিস্ফোরণ ঘটানোদের নাম-পরিচয় উঠে এসেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ডিসি ডিবি (দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায়।

সর্বশেষ খবর