সোমবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

নির্মমতার শিকার নারী ও শিশুরা

বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের প্রতি চলমান সহিংসতা হ্রাসে সরকারি ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন আইনজীবী, নারীনেত্রী ও মানবাধিকার কর্মীরা। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্বৃত্তদের এ জঘন্য প্রবৃত্তি থেকে রেহাই নেই শিশুদেরও। যৌতুক না পেয়ে নারীদের হত্যা এবং কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে তাদের অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। অথচ নারী নির্যাতন দমন ও অ্যাসিড সন্ত্রাস বন্ধে দেশে আইন আছে। তবে তার প্রয়োগ নেই। ফলে এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্টরা। নারীনেত্রীরা বলছেন, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংস নির্যাতন কমাতে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কিছু সদস্য, চেয়ারম্যান অর্থাৎ স্থানীয় প্রশাসন নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংস আচরণে জড়িত। নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন রোধে শুধু আইন প্রণয়ন করলেই যে সহিংসতা কমে আসবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। এ জন্য দরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। একই সঙ্গে নারী-শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ ভূমিকাও পালন করা প্রয়োজন। সারিয়াকান্দি উপজেলায় যৌতুকের জন্য এক গৃহবধূকে তার স্বামী গত ডিসেম্বর মাসে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের আমতলী গ্রামের ভটভটি চালক সিরাজুল স্ত্রী-সন্তান থাকার পরও আরেকটি বিয়ে করেন। নতুন স্ত্রীর কাছ থেকে তিনি যৌতুক দাবি করেন। আর তা না পেয়ে স্ত্রীকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। অন্যদিকে চাঁদপুরের মতলবে আট মাসের এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে (২২) তার স্বামী কন্যাশিশু গর্ভে ধারণ করায় শিশুটিকে হত্যা করতে বলেন। রাজি না হলে তার স্বামী অ্যাসিড নিক্ষেপ করে গৃহবধূটির মুখ ও দেহ ঝলসে দেন। আইনজীবীরা জানান, ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের জন্য মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি কোর্ট আছে। অথচ এখানে লাখ লাখ মামলা বিচারাধীন অবস্থায় পড়ে আছে। আর মামলাজট লেগে থাকলে নারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের মাত্রা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। ‘বাংলাদেশ অ্যাকশন এইড’ পরিচালিত জরিপে আরও জানা যায়, নিরাপত্তার অভাবে দেশে একা ঘরের বাইরে যেতে চান না ৬০ শতাংশ নারী। গণপরিবহন ও নির্জন স্থান এড়িয়ে চলেন যথাক্রমে ২৩ ও ২৬ শতাংশ নারী। জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের দেওয়া তথ্যে, ৮৫ শতাংশ নারী মানহানিকর উক্তির শিকার হয়েছেন। ৪৬ শতাংশ নারী যৌনতাপূর্ণ আশ্লীল ভাষার মুখোমুখি হয়েছেন। ৮৮ শতাংশ নারী বিপণিবিতানে বা বাজারে সাধারণ মানুষের কাছ থকে অশ্লীল বাক্য শুনেছেন। তবে নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন রাস্তাঘাটে। এমনকি নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যে পুলিশ সদস্যদের তাদের কাছ থেকেও তারা নির্যাতিত হচ্ছেন। ‘বাংলাদেশ অ্যাকশন এইড’-এর এক জরিপে জানা যায়, যৌন হয়রানির শিকার হলেও এ জন্য নারীরা পুলিশের সহায়তা চান না। এ নারীদের ৯৫ শতাংশ আছেন যারা মনে করেন নিজেদের সমস্যার কথা পুলিশকে জানালে সমস্যা আরও বেশি হতে পারে। এদিকে পুলিশও মনে করেন যে, ৬৫ শতাংশ নারীই ঘটনার জন্য দায়ী! এদিকে দেশব্যাপী আবারও অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা বেড়ে গেছে। অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের তথ্যে, ২০১৪ সালে দেশব্যাপী মোট অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ৫৬টি। এ সময় অ্যাসিডে ঝলসে গেছেন মোট ৭০ জন। এ সংস্থার মতে, প্রতি মাসে গড়ে অ্যাসিডে ঝলসে যান ১০ জন নারী। অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী মুনিরা রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মোবাইল কোর্ট করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা গেলে অ্যাসিড সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু অ্যাসিডের যত্রতত্র ব্যবহার রোধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি না। এ জন্য সরকারের শীঘ্রই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নারীর পাশাপাশি দেশের শিশুরাও প্রতিনিয়ত নানা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। গত নভেম্বরে রাজধানীর ভাটারায় সোলমাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীর (৯) হাত-পা বাঁধা লাশ সুজনটেক এলাকার ১০০ ফুট রাস্তার পাশের জলাশয় থেকে বস্তাবন্দী অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। শিশুটির পরিবারের দাবি, তাকে দুর্বৃত্তরা ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ জলাশয়ে ফেলে দেয়। এ ছাড়া দুই মাস আগে গত ২১ নভেম্বর পুরান ঢাকার ঘর থেকে বের হলে বাকপ্রতিবন্ধী এক শিশুকে (১০) ধর্ষণের পর অচেতন অবস্থায় বেড়িবাঁধের পাশে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে শিশুটিকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ১৬ জানুয়ারি ভোররাতে গাজীপুরের উত্তর সালনা এলাকায় গভীর রাতে বাড়িতে ঢুকে ১০ শ্রেণির এক কিশেরী ও তার বাবাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত। নিহতের স্বজনরা জানান, বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় স্থানীয় এক বখাটে ও মাদকাসক্ত যুবক সন্ত্রাসীদের নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এ অবস্থায় কন্যা শিশু-কিশোরীদের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, গ্রামে অভিভাবকরা সুরক্ষার নামে কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। সালমা আলী মনে করেন, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে প্রচলিত আইনগুলো ভালো। কিন্তু এর প্রয়োগে সংশ্লিষ্টদের আরও কঠোর হতে হবে। বিশেষ করে দেশে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মামলার সাক্ষী ও ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। আর এমনটি হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কমিটমেন্টের অভাবে। অন্যদিকে যারা অপরাধ ঘটাচ্ছে দেখা যাচ্ছে যে, তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক। এ জন্য মামলা করেও নির্যাতিতরা সঠিক বিচার পাচ্ছেন না। কারণ সাক্ষী ও ভুক্তভোগীর সুরক্ষা না থাকায় তারা আদালতে সাক্ষী দিতে আসছেন না। মামলা তুলে নিচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সালমা আলী বলেন, দৌলতদিয়া পতিতালয়ে জোরপূর্বক কন্যাশিশুদের পতিতা বানানো হচ্ছে। বিশেষ করে ফরিদপুরের একটি পতিতালয়ে ১০ থেকে ১৫ বছরের মেয়েদের জোরপূর্বক পতিতা বানানো হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট কাজ করছে। এলাকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, চেয়ারম্যান অর্থাৎ স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।এদিকে নারী ও শিশুরা রাজনৈতিক সহিংসতার হাত থেকেও রক্ষা পাচ্ছে না। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় পেট্রলবোমায় ও ককটেল বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে আহত হচ্ছে তারা। গতকাল ককটেল বিস্ফোরণে মোহাম্মদ ফাহিম (৮) ও মো. ইয়াছিন (৭) নামে দুই শিশু মধ্যবাড্ডা এলাকায় আহত হয়েছে। এ শিশু দুটির হাতে দুর্বৃত্তরা বলসদৃশ বস্তু তুলে দিলে খেলার একপর্যায়ে ককটেলটি বিস্ফোরিত হয়। এ ছাড়া একই দিন বিকালে মানিকমিয়া এভিনিউয়ের সংসদ ভবনের খেজুরবাগান এলাকায় যাত্রীবাহী একটি বাসে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় ইডেন মহিলা কলেজের দুই শিক্ষার্থী মারাত্মক দ্বগ্ধ হন। এ সময় বাসে থাকা আরও দুই ছাত্রী আহত হন। 

সর্বশেষ খবর