বৃহস্পতিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

নিহতদের খোঁজ নিচ্ছে না কেউ

‘আমাগের কষ্ট আমাগেরই রইল। পুইড়া মইরল আমার ধনেরে। ছেইলেডা চালাতো। কেউ ডাইকে দিলে খাওয়া জুডে, নইলে না খাইয়েই থাকতি হচ্ছে। যা জমানি টাকা ছেইলো, কিছুই তো আর নেই। কেউ কোনো খবরও নেয়নি, দুটা টাকাও দেয়নি। কইনে যাব, কাকে বইলব কষ্টের কথা। দাপাতি দাপাতি মোইরতেছি।’ এই আর্তনাদ মাগুরার এক সন্তানহারা অসহায় মায়ের। বুকের ধনকে হারিয়ে বৃদ্ধা মা নূরজাহান বেগম এখন পাগলপ্রায়। পথে বেরিয়ে রাজনীতির নৃশংস বলি হয়েছেন তার সুস্থসবল যুবক সন্তান মুরাদ মোল্লা। বাবা, মা, ভাই ও একমাত্র বোন নিয়ে পাঁচজনের এই পরিবারটির ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মুরাদ মোল্লা। তার মৃত্যুর পর পুরো পরিবারটি এখন পথে বসে গেছে। সামনে তাদের অমানিশার অন্ধকার। ১০০ টাকার সাহায্যও জোটেনি পরিবারটির ভাগ্যে। খেয়ে না খেয়ে অনিশ্চিত এক জীবনের পথে পরিবারটি। রুটিরুজির জন্য পথে বের হওয়া এই মুরাদ মোল্লার মতোই টানা অবরোধের প্রথম ২২ দিনে ৩৮ জনকে জীবন দিতে হয়েছে। যারা জীবনে কখনোই রাজনীতির ধারেকাছে ঘেঁষেননি। কিন্তু রাজনীতির বলি হতে হয়েছে তাদেরই। এই ৩৮ জনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যু হয় সাতজনের। হাসপাতাল থেকে ফিরে যাওয়ার পর একটি পরিবার বাদে কোনো পরিবারের খোঁজ কেউ রাখেনি। সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু কথা রাখেননি কেউ। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি চলে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা এখন দিশাহারা। অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন কাটছে তাদের। কারও লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এ অকূল পাথারে কে ভরসা দেখাবে, কে দাঁড়াবে পাশে- এ প্রশ্নের উত্তর তাদের জানা না থাকলেও, স্বজন হারানোর বেদনা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালো মেঘ ঘিরে ধরেছে তাদের। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া টানা অবরোধের নামে পেট্রলবোমা হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা পেট্রলবোমা হামলা চালায় যাত্রীবোঝাই বাসে, মালবাহী ট্রাকে। বোমার আগুনে পুড়ে যায় শরীর। ঢামেক বার্ন ইউনিটে যারা ভর্তির পর মারা যান তারা হলেন মুরাদ মোল্লা (২০), গৃহিণী তছিরন বেগম (৬০), প্রাইভেট কার চালক আবুল কালাম (৩০), শিশু জাকির হোসেন (১১), আবদুর রহিম (৩০), ট্রাকচালক বকুল দেবনাথ (৩৫) এবং ছাত্র সানজিদ হোসেন অভি (১৯)। কবি নজরুল কলেজের মেধাবী ছাত্র সানজিদ হোসেন অভি (১৯) বোমাবাজদের হামলায় নিহত হন। ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর বঙ্গবাজারের কাছে বোমার আঘাতে আহত হয়ে ঢামেক বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন অভি। ২১ জানুয়ারি তিনি মারা যান। এক বোমাতেই শেষ হয় অভির জীবন। শেষ হয় একটি পুরো পরিবারের আশা-ভরসা। অভির দরিদ্র বাবা জানান, অনেকেই আশ্বাস দিয়েছিলেন, কেউ কথা রাখেননি। তবে আশ্বাস না দিয়েই বাসা থেকে ডেকে এনে আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম এবং তার বন্ধু রাজনীতিবিদ নূর মোহাম্মদ। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এত লোক এসে কথা বললেন, সহমর্মিতা জানালেন। সবার সামনে বলে গেলেন, আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর কেউ একটিবারের জন্য খোঁজখবরও নেননি। সাহায্য তো দূরের কথা। ছয় দিন হাসপাতালের বেডে দুঃসহ যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন বকুল দেবনাথ। ৩৫ বছরেই ঝরে পড়ে পেট্রলবোমায় সিলেটে দগ্ধ ট্রাকচালক বকুল দেবনাথের প্রাণ। অন্যদিকে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসেছে তার পরিবার। পরিবারের সদস্যদের জীবন-জীবিকা কীভাবে চলবে- এ প্রশ্নের উত্তর তাদের জানা না থাকলেও, স্বজন হারানোর বেদনা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালো মেঘ ঘিরে ধরেছে তাদের। তবে বকুল দেবনাথের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও কালের কণ্ঠ। এ ছাড়া তাদের সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে আসেনি। বকুল দেবনাথ ২২ জানুয়ারি দগ্ধ হন আর মারা যান ২৭ জানুয়ারি। বগুড়ার নুনগোলায় ২৩ জানুয়ারি অবরোধকারীদের পেট্রলবোমার আগুনে মারাত্মকভাবে দগ্ধ ট্রাকের হেলপার আবদুর রহিম পরদিন সকালেই বার্ন ইউনিটে মারা যান। তার মৃত্যুর পর পুরো পরিবারটি এখন পথে বসেছে। তার দুই সন্তান ১৪ বছরের সানজিদ আলম সম্রাট ও আট বছরের সুমাইয়া আক্তারের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রহিমের ভাই রমজান জানান, তাদের ভরণ-পোষণের কেউ নেই এখন। লেখাপড়া চালানোটা কঠিন হয়ে পড়বে। নিজেদের খরচেই লাশ আনতে হয়েছে বাড়িতে। সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি। তিনি বলেন, তবে হাসপাতালে শুনেছিলাম, অনেকে এসে বলেছিলেন সহযোগিতা করবেন। রহিমের ভাই রমজান আরও জানান, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নের শ্রীরামপুরে তাদের গ্রামের বাড়ি। রহিমের স্ত্রীর নাম মজিদা বেগম। এই পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই। একই অবস্থা অন্য নিহতদের পরিবারের। অনেকেই তাদের বলেছিলেন আর্থিক সাহায্য করবেন। কিন্তু তাদের লাশ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়েছে নিজ খরচে। জমা যত টাকা-পয়সা ছিল, তা ওষুধপথ্য কিনতেই শেষ। নিহতদের পরিবারগুলোর এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

সর্বশেষ খবর