শনিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

নেতিবাচক প্রভাব রাজস্ব আদায়ে

দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ঢেউ লেগেছে সরকারের রাজস্ব খাতে। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ-হরতালে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ভাটা পড়ায় নৌ ও স্থলবন্দরগুলোতে কমেছে শুল্ককর আদায়। সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় ভ্যাট আদায়ে ধস নেমেছে। পাশাপাশি সারা দেশের কর কার্যালয়গুলোতেও প্রত্যাশিতভাবে আয়কর আদায় হচ্ছে না বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। জানুয়ারি মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার এই চিত্রে হুমকির মুখে পড়েছে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের টার্গেট। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার পরও অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের নিট রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৭৭৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৬০ হাজার ৪৫৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আর জানুয়ারি মাসজুড়ে সারা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার ঢেউ লেগেছে শুল্ককর, ভ্যাট ও আয়কর আদায়ে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে রাজস্ব আদায়ে বিপাকে পড়বে সরকার। এমন প্রেক্ষাপটে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) লক্ষ্যমাত্রার আরও প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে না বলে মনে করেন এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা আরও বলেন, রাজস্ব খাতে দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি ভ্যাট প্রশাসনে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতিও চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ অবস্থায় সম্প্রতি চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ২৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।  তবে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় রাজস্ব আদায়ে কোনো জটিলতা নেই। তাই রাজস্ব ঘাটতিরও সম্ভাবনা দেখছি না। রাজস্ব আদায়ে কারও ভয়ভীতি তোয়াক্কা করবে না রাজস্ব প্রশাসন। করদাতাদের হয়রানি করা হবে না। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে নিজের অঙ্গীকারের কথা জানিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ২০২১ সালে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর এক্ষেত্রে ৮০ ভাগ রাজস্ব আসে এনবিআর থেকে। গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৬০ হাজার ৪৫৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর কাগজে-কলমে আদায় দেখিয়েছে ৫৮ হাজার ৪৪৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। তবে সরকারের কোষাগারে জমা বা নিট আদায় হয়েছে ৫০ হাজার ৬৭৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের মোট লক্ষ্যমাত্রা থেকে নিট রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৭৭৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। ফলে জানুয়ারি থেকে আগামী জুন পর্যন্ত এই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার বাকি ৯২ হাজার কোটি টাকা আদায় করার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এনবিআর।  এ অবস্থায় হরতাল-অবরোধের মতো চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জন করতে সক্ষম হবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ীদের প্রাচীন সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি সবুর খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চলমান এই রাজনৈতিক পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে রাজস্ব আদায়ে চরম বিপজ্জনক অবস্থায় পড়বে সরকার। যারা রাজস্ব আদায় করবেন এবং যারা রাজস্ব দেবেন উভয়ে বিপদে পড়বেন। কারণ জোর করে রাজস্ব আদায় করা যায় না। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সহিংসতা ও নাশকতার প্রভাব পড়েছে দেশের নৌ ও স্থলবন্দরগুলোতে। দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামের পাশাপাশি রাজস্ব আদায় কমেছে বেনাপোল, হিলি, সোনামসজিদ স্থলবন্দরসহ অধিকাংশ বন্দরে। এর সঙ্গে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ- সব ধরনের ব্যবসাতে হরতাল ও অবরোধের প্রভাবে কমেছে ভ্যাট আদায়। দেশের অধিকাংশ কর কার্যালয়গুলোও হরতাল-অবরোধের কারণে আয়কর আদায় করতে পারছে না। ডিসিসিআইর এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশের চারটি প্রধান স্থলবন্দর ও টোল আদায় থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩৪ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। চলমান অবরোধের প্রথম ২২ দিনে কেবল এসব খাত থেকে রাজস্ব আদায় কমেছে ৭৪৮ কোটি টাকা। দেশের ২০টি স্থলবন্দর থাকলেও নিয়মিত আমদানি-রপ্তানি হয় যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার ভোমরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, দিনাজপুরের হিলি, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, সিলেটের তামাবিল, কক্সবাজারের টেকনাফ ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। এসব বন্দরেও আমদানি-রপ্তানি কমার প্রভাব পড়েছ রাজস্ব খাতে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজস্ব আহরণের প্রধান তিনটি খাতের মধ্যে আয়কর, আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ের শুল্ক খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট খাত পিছিয়ে পড়েছে। ফলে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ে ধস নামার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন এনবিআরের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা।  এ অবস্থায় সাম্প্রতিককালে করদাতাদের হয়রানি বন্ধ করতে মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোতে পাঠানো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়, করদাতাদের আয়কর বিবরণী (রিটার্ন) বা এ সংক্রান্ত কাগজপত্রাদি বা করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ইত্যাদির জন্য দরখাস্ত দাখিলের ক্ষেত্রে করদাতারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, মাঠ পর্যায়ের কর অফিসগুলোতে অধিকাংশ করদাতাকেই হয়রানি করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে হয়রানির শিকার হন নতুন করদাতারা। চাকরিজীবী নতুন করদাতাদের বাড়ি ভাড়াসহ আয়-ব্যয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্ট দিতে বলা হয়। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে অনেক ডকুমেন্টই নানা কারণে সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের অভিযোগ প্রায়ই এনবিআরে আসছে বলে সূত্র জানায়।

সর্বশেষ খবর