শনিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা
বার্ন ইউনিট

শুধুই গোঙানির শব্দ

শুধুই গোঙানির শব্দ

খিলগাঁওয়ে গতকাল বাসে আগুনে দগ্ধদের একজন -রোহেত রাজীব

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটজুড়ে মানুষের শরীরের পোড়া গন্ধ। চারদিকে দগ্ধ রোগীর গোঙানির শব্দ। কখনো বা যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠছেন। তাদের চিৎকার ও কান্নায় বার্ন ইউনিটের পরিবেশ ভারী করে তুলছে। ব্যান্ডেজে মোড়া কারও পুরো শরীর, কারও বা অর্ধেক। যন্ত্রণাকাতর মানুষের চিৎকার-গোঙানির শব্দ বার্ন ইউনিটজুড়ে। সঙ্গে স্বজনদের বোবা কান্না। কিছুক্ষণ পরপর চোখ মুছছেন তারা। প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে কেবিন, করিডরসহ পুরো ওয়ার্ডের মেঝেতে রোগী। যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানালেন, টানা অবরোধে আগুনে দগ্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত ৪৮ জন পোড়া রোগী বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৫ জন, মহিলা ও শিশু রোগীর সংখ্যা ৩ জন। এসব দগ্ধ রোগী কেউ দিনমজুর, কেউ ট্রাক বা বাসের চালক-হেলপার, কেউ শিক্ষার্থী, কেউ নিতান্তই সাধারণ মানুষ। তারা কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। অথচ জীবন জীবিকা নির্বাহের তাগিদে রাস্তায় বের হয়ে এখন তাদের স্থান হয়েছে বার্ন ইউনিটে। জীবন-সংগ্রামে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তারা। দগ্ধ এসব মানুষকে সারিয়ে তুলতে দিন-রাত চিকিৎসকদের সঙ্গে অবিরত পরিশ্রম করছেন স্বজনরা। চোখের সামনে আপজনকে ছটফট করতে দেখে তাদের মনের ভিতরটা হু হু করে উঠছে। নিত্যসঙ্গী কান্নায় আর চোখের পানি বের হচ্ছে না তাদের। শুধু ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। স্বজনদের বীভৎস চেহারা দেখে তারা সহ্য করতে পারছেন না। কখন ভালো হবে তার স্বজন আর কখন বাড়ি ফিরবে তারা এ অপেক্ষায় প্রত্যেকেই।
২৩ জানুয়ারি পেট্রলবোমার আগুনে দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটের হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) চিকিৎসাধীন প্যান্টের দোকানের কর্মচারী সালাউদ্দিন ভূইয়া। আগুনে তার শ্বাসনালিসহ ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। যন্ত্রণায় এখনো কাতরাচ্ছেন তিনি। আগুনে তার শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। হাঁ করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। হাঁপানি রোগীর মতো হাঁপাচ্ছেন। আর ঘটনার দিন থেকে গতকাল পর্যন্তও কান্না থামেনি নববধূ ঊর্মির। স্বামীর ক্ষত শরীরের মলম দিতেই চোখ বেয়ে পানি ঝরছে তার। শব্দহীন কান্নায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। সালাউদ্দিনের মায়ের বোবা কান্নাও বার্ন ইউনিটের পরিবেশ ভারী করে তুলছে। সংকটাপন্ন শ্রমিক জমির আলীর অবস্থা দেখে চোখে পানি চলে আসে। তার স্ত্রীর নাম পারভীন আক্তার। ওই দম্পতির তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। সন্তানরা বাবার ঝলসানো মুখ দেখে আঁতকে উঠছেন। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছিলেন ছেলে রুবেল। কথা হয় রুবেলের সঙ্গে। তিনি জানান, ২৩ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীতে পেট্রলবোমার আগুনে দগ্ধ হন তার বাবা জমির আলী। ঘটনার পর থেকে তাদের পরিবারে অর্থ সংকট নেমে এসেছে। খুবই কষ্টে চলছে তাদের সংসার। রুবেলের দিকে তাকানোর সময় মনে হচ্ছিল, কোনো অজানা আশঙ্কা তাকে তাড়া করে ফিরছে। একই ঘটনায় দগ্ধ রুবেল যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। মাছের মতো মুখ হাঁ করে রাখছেন। তার কণ্ঠস্বর আর নাক দিয়ে গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই অঝোরে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে স্বজনের। শুধু সালাউদ্দিন, জমির আলী কিংবা রুবেলই নন; বার্ন ইউনিটে ভর্তি দগ্ধ ৪৮ জন মানুষ ও তাদের স্বজনদের একই অবস্থা। তবে এদের মধ্যে ৩০ জনের শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় তাদের অবস্থা সংকটাপন্ন। এদের আর্তচিৎকার যেন থামছে না। সঙ্গে এদের স্বজনরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন, কখন সুস্থ হবেন প্রিয় মানুষটি। বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছয়জনের গোঙানি শব্দে আইসিইউতে বিরাজ করছে অন্য এক পরিবেশ। আইসিইউর বাইরে বসে আছেন স্বজনরা। আপনজনের বীভৎস চেহারা দেখে তারা অনেকেই শিহরে উঠছেন। আইসিইউর দরজার দিকে তাকিয়ে থাকছেন তারা, কখন চিকিৎসকরা প্রিয় মানুষটিকে ড্রেসিংয়ের জন্য বের করবেন, কখন এক পলক তাকে দেখবেন। চিকিৎসকরা রোগীর নাম ধরে ডেকে তার এক স্বজনকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেন। আর স্বজনরা আপনজনের সান্নিধ্যে পেয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছেন। আইসিইউতে থাকা দগ্ধদের বেশ কয়েকজন স্বজন জানান, দগ্ধরা অস্ফুট স্বরে অনেক কথা ব্যক্ত করছেন। কিন্তু শঙ্কা বিরাজ করছে তাদের মনে। না জানি সেই শঙ্কার কাছে হেরে চিরতরের জন্য চলে যেতে হয়।
 

সর্বশেষ খবর