শিরোনাম
শনিবার, ৭ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

আমি চাই স্বাধীনতা

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

১. বাঙালি জাতির জীবনে তেসরা মার্চ টার্নিং পয়েন্ট। ওই দিন ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে, জাতীয় সংসদ সদস্যরা শপথ নেবেন এবং সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হবেন। বঙ্গবন্ধু ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে বলেছিলেন ছয় দফার প্রশ্নে আলোচনার জন্য অধিবেশন মুলতবি করা হবে। তিনি ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অধিবেশন ডাকার আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ভুট্টোকে ক্ষমতার ভাগ দেওয়া হবে কি না? বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট জবাব ছিল সেটা আমার বিষয়। পশ্চিম পাকিস্তানে অন্যান্য দল রয়েছে। ইয়াহিয়া খান বুঝতে পারলেন ভুট্টোর কোনো চান্স নেই। ফিরে যাওয়ার সময় ঢাকা বিমানবন্দরে তিনি বললেন, শেখ মুজিব হবেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। ২. ১৭ জানুয়ারি সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে ইয়াহিয়া খান লারকানায় ভুট্টোর সঙ্গে বাসভবনে দেখা করেন। লারকানায় ভুট্টো বলেন, বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। সামরিক কর্মকর্তারা একমত হন। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় পাঠান শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাপ করতে। ভুট্টো চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ। বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল ছয় দফা মানলে সবকিছু সম্ভব। ভুট্টো ৩০ জানুয়ারি ফিরে যাওয়ার সময় বললেন, আলোচনার দরজা বন্ধ হয়নি। ২২ ফেব্রুয়ারি সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থা ও গভর্নরদের যৌথ মিটিংয়ে সিভিলিয়ান মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। দেশকে পুনরায় সামরিক কব্জায় নেওয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বললেন, ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বাংলার জনগণকে তারা ক্ষমতা দেবে না। সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। ঘরে ঘরে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। আমি থাকব কি না জানি না কিন্তু স্বাধীনতার ও মুক্তির লক্ষ্যে আপনাদের এগিয়ে যেতে হবে। ৩. পহেলা মার্চ বেতারে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ঘোষিত তেসরা মার্চের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। পহেলা মার্চে সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে গভর্নর আহসানকে বঙ্গবন্ধু বলেন, অবিলম্বে পরিষদ আহ্বানের ঘোষণা দিতে হবে নইলে জনগণ আমাকে চাপ দিচ্ছে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার। ওই দিন গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসানকে সরিয়ে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবকে গভর্নর, প্রাদেশিক সামরিক প্রধান ও প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। সেনাবাহিনী নামানো হয়। কার্ফু জারি হয়। জনগণ তা মানেনি। শুরু হয় উত্তাল আন্দোলন। ক্যান্টনমেন্টে খাদ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৩ মার্চ পল্টনে জনসভায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। ইশতেহার পঠিত হয় লাখো জনতার সামনে। ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা ও সর্বাধিনায়ক। জাতীয় সংগীত গীত হয়। চারদিকে স্লোগান ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। সারা দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্রতর হয়। ওই দিনই ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হন। ৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তার আহ্বানে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নেওয়া হয়। ওই দিন ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’র নাম পাল্টিয়ে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ রাখা হয়। ৭ মার্চের আগে কয়েকটি কূটনৈতিক ও সামরিক নাটকীয়তা ঘটে। ১. এর মধ্যে সাহেবজাদা ইয়াকুব পরিষদ স্থগিত ঘোষণা ও তাদের অনুরোধে পুনরায় সংসদ অধিবেশনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না করায় তিনি পদত্যাগপত্র পেশ করেন। ২. জেনারেল টিক্কা খান ৬ মার্চ গভর্নর হন। ৩. ইয়াহিয়া খান ৭ তারিখের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের গোলটেবিল আহ্বান করেন। ৪. ২৫ মার্চ নতুন করে সংসদ আহ্বান করেন। ৫. ৬ তারিখ রাতটি ছিল উত্তপ্ত। ৬. আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বৈঠকে বসেন। গভীর রাতে বৈঠক মুলতবি হয়। ৭. ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোনে অনুরোধ করেন ‘আমার অনুরোধ তাড়াতাড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। শিগগিরই আমি ঢাকায় এসে আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমি আশ্বাস দিতে পারি যে, জনগণের কাছে আপনার প্রদত্ত ওয়াদা পালিত হতে পারে।’ সকালে টেলেক্স বার্তাটি একজন ব্রিগেডিয়ার বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দেন। ৮. রাতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং নিউক্লিয়াসের নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে জোরেশোরে অনুরোধ করেন। ৯. ৭ মার্চ পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড সকালে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে একান্ত বৈঠকে বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করেব না’। সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে সাহেবজাদা ইয়াকুব বলে পাঠান একতরফা স্বাধীনতা ঘোষিত হলে শাসন করার জন্য এবং শাসিত হওয়ার জন্য কেউ থাকবে না। রাইফেল, কামান, ট্যাঙ্ক, ভারী অস্ত্র নিয়ে রমনা পার্কে আগেই বেলুচ রেজিমেন্ট অবস্থান নিয়েছিল। বিমানবন্দরে বিমানবাহিনীকে রণসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। পদাতিক বাহিনীর ওপর যুদ্ধে যাওয়ার রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। একদিকে জনগণের দাবি স্বাধীনতা অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর উদ্যত আক্রমণ পরিকল্পনা। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কী করবেন? তেসরা মার্চ বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তাকে স্বাধীনতা ঘোষণার দিকে পরিস্থিতি তাড়িত করছে’। অফ দ্য রেকর্ডে তিনি আরও বলেন, ‘তিনি যা বলবেন তা হবে স্বাধীনতার সমার্থক যা স্বাধীনতার বৃত্তে চলে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নথিতে বলা হয়েছে, সম্ভবত মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। হেনরি কিসিঞ্জার এক বৈঠকে এভাবে মূল্যায়ন করেন যে, তার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যা তিনি প্রকারান্তরে ঘোষণা করেছেন।’ বঙ্গবন্ধু মার্ক টালিকে বলেন, আমি চাই স্বাধীনতা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বজ কণ্ঠে স্বাধীনতার সেই কাক্সিক্ষত-কাব্যিক বাণী উচ্চারণ করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। (৭২ খসড়া সংবিধানপ্রণেতা, গবেষক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী)

সর্বশেষ খবর