বুধবার, ৬ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

অগোছালো বিএনপি

* নির্বাহী কমিটির মেয়াদ নেই * নগর জেলা থানা কমিটি বেহাল * পুনর্গঠন চায় তৃণমূল

অগোছালো বিএনপি

দীর্ঘ দুই বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি। ঢাকা মহানগরসহ অধিকাংশ জেলা-উপজেলায় নেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ‘অগোছালো’ সংগঠন নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছে দলটি। কেন্দ্রের ব্যর্থতার মাশুল গুনতে হচ্ছে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। মামলা-হামলায় জর্জরিত হয়ে তারা এখন নাচার। ৩৮৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটির অধিকাংশই ‘নিষ্ক্রিয়’। তিন মাসের আন্দোলনে অধিকাংশই ছিলেন আত্মগোপনে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক ‘চেইন অব কমান্ড’ও ভঙ্গুর। বেহাল অবস্থায় জেলা, থানা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন কমিটিগুলো। এ অবস্থায় দলে শুদ্ধি অভিযান চায় তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। নতুন করে আন্দোলনে যাওয়ার আগে দল পুনর্গঠন জরুরি বলেও মনে করেন তারা। নইলে আন্দোলনে কোনো সফলতা আসবে না। মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে বিএনপির এই নাজুক পরিস্থিতির কথা জানা গেছে।  সর্বশেষ বিএনপির কাউন্সিল হয় ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর কাউন্সিল করার কথা। ২০১২ সালের শেষের দিকে জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতিও নেয় বিএনপি। এ জন্য ভেন্যুও ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু কাউন্সিলের আগ মুহূর্তে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৫৪ জন নেতা-কর্মীকে নয়াপল্টন কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য কাউন্সিলকে ঘিরে ওই সময় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত  নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দলও বেড়ে যায়। এরপর কয়েক দফা চেষ্টা করেও কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। অবশ্য নির্বাচন কমিশন থেকে কয়েক দফায় সময়ও নেওয়া হয় বিএনপির পক্ষ থেকে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিগত আন্দোলন ও নির্বাচন নিয়ে আমরা বিশ্লেষণ করছি। এর মধ্যে আমাদের ভুলত্রুটিগুলোও শুধরানোর চেষ্টা করছি। আগামীতে আন্দোলনকে সামনে রেখে দলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। যেসব এলাকায় সংগঠনে দুর্বলতা আছে, তা চিহ্নিত করে পুনর্গঠনও করতে হবে। আশা করি, শিগগিরই আমরা সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হব।’
চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় সূত্র জানায়, সদ্য সমাপ্ত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও সংগঠনকে শক্তিশালী করার চিন্তা-ভাবনা করছেন। গুলশান কার্যালয়ে এসে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলেছেন তিনি। এ সময় দলের কোনো কোনো নেতা দলের মেয়াদোত্তীর্ণ কাউন্সিল ও নির্বাহী কমিটির সভা করার বিষয়েও দৃষ্টি আনেন খালেদা জিয়ার। তবে বিএনপি প্রধান বলেন, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ নেতা-কর্মীরা বেরুলেই সাংগঠনিক পুনর্গঠন নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে। এরপরই আন্দোলনে যাওয়া যাবে।
বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দল পুনর্গঠনের বিষয়ে ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) মনোভাব ইতিবাচক। সিনিয়র নেতাদের কারামুক্তি হলে আগামী দুই মাসের মধ্যে কাউন্সিলসহ দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। এর মধ্যে বড় কোনো ইস্যু না সৃষ্টি হলে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়া হবে না।    
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘ তিন মাসের আন্দোলনে ফল ঘরে তোলার আগেই তা বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এরপর হঠাৎ করেই সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে আগেভাগেই ভোট বর্জনেও হতাশ তারা। ভোট ডাকাতির অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করার পর কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার বিষয়টিকেও ভালোভাবে নিচ্ছেন না বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
তাদের অভিযোগ, দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের কৌশল গ্রহণেই বড় ধরনের ত্রুটি ছিল। মাঠের বাস্তবতা অনুযায়ী সঠিক চিত্র হাইকমান্ডের কাছে তুলে ধরেনি একটি মহল। দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি ও সিনিয়র নেতাদের থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কৌশলে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। একইভাবে আন্দোলনে থাকা নেতাদের থেকেও বিএনপি প্রধানকে আলাদা করে ফেলা হয়। তা ছাড়া তিন মাসের আন্দোলনে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দেয় ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতারা। যে কারণে বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত ব্যাকফুটে চলে যেতে হয়েছে। অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ডেকে ঘোষণা ছাড়াই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গুলশান কার্যালয়ে অনড় থাকা বেগম জিয়াকেও আদালত থেকে জামিন নিয়ে বাসায় ফিরে যেতে হয়েছে।  
চট্টগ্রামের বাকলিয়ার এক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপিতে বড় বড় পদে থাকা কিছু সুবিধাবাদী, বিত্তশালী ও মোনাফেক নেতাকে বাদ দিতে হবে। পরীক্ষিত, ত্যাগী, যোগ্য ও দক্ষ নেতাদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করলেই আন্দোলনে গতি আসবে। তা ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনকেও গুলশান কার্যালয়ের আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্ভরতা বাদ দিয়ে দলের ত্যাগী নেতাদের পরামর্শ নিতে হবে। কূটনৈতিক পর্যায়েও রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া চেয়ারপারসনকে গুলশান কার্যালয়ের পাশাপাশি সপ্তাহে অন্তত তিনদিন নয়াপল্টন কার্যালয়ে অফিস করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
দলীয় সূত্র মতে, দীর্ঘ তিন মাসেরও বেশি সময়ের আন্দোলন হঠাৎ করে বন্ধ করে দিয়ে আদালত থেকে ঘরে ফেরার পর কিছু বুদ্ধিজীবী ও কার্যালয়ের কর্মকর্তার প্ররোচনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি নির্বাচনে দলীয় নেতাদের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত দেন খালেদা জিয়া। এ বিষয়ে ২০-দলীয় জোটের শরিকদের মতামতও নেয়নি বিএনপি। নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর সমর্থন নিয়েও দলের মধ্যে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কয়েক দফায় কাউন্সিলর পদে রদবদলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।  
জানা যায়, কেন্দ্রীয় নেতারা নিষ্ক্রিয় থাকায় বিএনপির দলীয় কর্মকান্ড এখন প্রায় ‘বিবৃতি-নির্ভর’ হয়ে পড়েছে। এমনকি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আহ্বানেও কোনো কর্মসূচি এখন আর তেমনভাবে পালন হয় না। কেন্দ্রীয় নেতারাও কথায় কথায় মামলা-হামলা, গ্রেফতার আর পুলিশের গুলিসহ গুম-খুনের অজুহাত দেখান। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ তৃণমূল বিএনপি। এ ছাড়া নির্বাচনের দিন-দুপুরে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়াকেও ভালোভাবে নেয়নি মাঠের নেতা-কর্মীরা।
তাদের মতে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের কোথাও সেদিন (২৮ এপ্রিল) বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীকে কেন্দ্র পাহারা দূরের কথা, কোনো কেন্দ্রের আশপাশেও দেখা যায়নি। ঢাকায় ৯০ ভাগ কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টই আসেননি। চট্টগ্রামে এজেন্টরা কেন্দ্রে গেলেও ভোটগ্রহণের পরপরই তারা বেরিয়ে যান। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
বিএনপির গলার কাঁটা ঢাকা : ৫ জানুয়ারির ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের বছর পূর্তি উপলক্ষে গত জানুয়ারি থেকে সারা দেশে কম-বেশি আন্দোলন হলেও পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দেয় ঢাকা মহানগর বিএনপি। সেই সঙ্গে ব্যর্থতার দায় বর্তায় কেন্দ্রীয় অঙ্গ-সংগঠনগুলোর ওপরও। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত তিন মাসের ফলাফল-শূন্য আন্দোলনের দায়ভারও ঢাকা মহানগর বিএনপির দিকে ইঙ্গিত তৃণমূল বিএনপির। গেল বছরের ১৮ জুলাই মির্জা আব্বাসকে মহানগর আহ্বায়ক ও হাবিব-উন নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে ৫২ সদস্যের হাইপ্রোফাইলের ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মহানগরে ৪৯টি থানা ও ১০০টি ওয়ার্ড ও ১৮টি ইউনিয়নের সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে। দুই মাসে কাউন্সিল করে মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কয়েক দফায় উদ্যোগ নিয়েও থানা-ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি দলটি। প্রায় ১০ মাসেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। অবশ্য বিগত কয়েক মাস ধরেই মামলার হুলিয়া নিয়ে দায়িত্ব পাওয়া নেতারা আত্মগোপনে। এখনো তারা প্রকাশ্যে আসতে পারেননি।
জেলা-উপজেলাও সাংগঠনিক বেহাল অবস্থা : কেন্দ্রের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও বেহাল সাংগঠনিক অবস্থা। বিএনপির সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের পকেটে তৃণমূলের এসব কমিটি। অধিকাংশই তিন বা ৫ সদস্য বিশিষ্ট। অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোরও একই অবস্থা। প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতাদের সমর্থকরাই অঙ্গ-সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। আন্দোলন সংগ্রামে অধিকাংশ নেতাদের নেই কোনো ভূমিকা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে মাঠ পর্যায়ের যারা আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন- তাদের খোঁজ-খবরও নিচ্ছেন না তারা। মাঠের ত্যাগী নেতাদেরও নেতৃত্বে বাধা সাবেক মন্ত্রী এমপিরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও নাটোরের লালপুর বিএনপি নেতা তাইফুল ইসলাম টিপু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচন ও আন্দোলনে বিএনপির ত্রুটিগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। এখন বিএনপির হাইকমান্ডের উচিত, সাধারণ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে সকল পর্যায়ের কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা। এতে সংগঠন যেমন শক্তিশালী হবে, ঠিক আন্দোলনেও ত্যাগী নেতা-কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে’।

 

সর্বশেষ খবর