শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

চার্জশিট আতঙ্কে বিএনপি

উদ্দেশ্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য করা

চার্জশিট আতঙ্কে বিএনপি

রাজধানীর রামপুরা থানার ‘নাশকতা’ মামলায় গতকাল বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সাদেক হোসেন খোকা, আমানউল্লাহ আমান, সালাহউদ্দিন আহমেদসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। যাত্রাবাড়ীতে আগুনে পুড়িয়ে ‘হত্যা’ মামলায় একদিন আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে দুটি চার্জশিট জমা দেওয়া হয়। গত বছর ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে বিভিন্ন সময় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর হঠাৎ করেই অভিযোগপত্র দাখিলে বিএনপিতে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। নেতা-কর্মীরা একে বলছেন, ‘চার্জশিট আতঙ্ক।’
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, জিয়া পরিবারসহ সিনিয়র নেতাদের নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই ক্ষমতাসীন সরকার প্রতিনিয়ত ‘মিথ্যা’ মামলায় জড়াচ্ছে তাদের। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব মামলায় অভিযোগপত্র জমা নিয়ে বিএনপিতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। উদ্দেশ্য, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের ‘সাজা’ দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। এ ছাড়া সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন যেন গড়ে উঠতে না পারে সে উদ্দেশ্যে বিএনপিতে ভাঙন সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। গত সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে একাধিকবার এ চেষ্টা চালানো হয়। একইভাবে ২০-দলীয় জোটের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি করতেও অপকৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব করে সরকারের শেষ রক্ষা হবে না। এমন অভিমত প্রকাশ করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, গত ৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে নাশকতার অভিযোগে ১ হাজার ৭৭৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এ সংক্রান্ত মামলায় ১৮ হাজার ৩৮ জনকে গ্রেফতার করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। দায়েরকৃত মামলাগুলোর মধ্যে ১২০টির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্র দেওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ডিএমপির ৪০টি এবং অন্যান্য মহানগর এলাকার ৮০টি মামলা রয়েছে। একটি মামলার তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দাখিল করা হয়েছে। তদন্তাধীন ১ হাজার ৬৫৪টি মামলা। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার বিএনপিকে ব্যস্ত রাখতেই প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন মামলায় জড়াচ্ছে। রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে চেয়ারপারসনসহ সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেওয়া হচ্ছে। যাতে জিয়া পরিবারসহ কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, সেই কৌশলই নিচ্ছে সরকার। কিন্তু তাদের এই উদ্দেশ্য সফল হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নাশকতার অভিযোগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৭৭৫টি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে নাশকতার মামলার। জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আগের পাঁচটিসহ এ পর্যন্ত ১৮টি মামলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এরই মধ্যে উচ্চ আদালতে স্থগিত থাকা গ্যাটকোর পর নাইকো ও বড়পুকুরিয়া মামলা সচল করা হয়েছে। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান চিকিৎসার নামে বিদেশে অবস্থানকারী তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত অন্তত ২৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। একইভাবে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ৭৩টি মামলার আসামি হয়ে বর্তমানে কারাগারে। তার বিরুদ্ধে অন্তত ২৫ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদে ষষ্ঠবারের মতো জেল খাটছেন তিনি। জানা গেছে, আদালতে চার্জশিট দেওয়া প্রসঙ্গে বেগম জিয়া ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন, জেল-জুলুম কিংবা মামলায় সাজার ভয় পান না তিনি। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এসব মামলায় চার্জশিট দিয়েও কোনো লাভ হবে না। ন্যায়বিচার  পেলে উচ্চ আদালতে কোনো মামলাই টিকবে না বলেও তার বিশ্বাস। দলীয় সূত্র বলছে, মামলার ঘানি টানতে গিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠছে এখন। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আদালতপাড়ায় দৌড়াতে গিয়ে নিঃস্ব প্রায়। সাময়িকভাবে আন্দোলন স্থগিত থাকলেও গ্রেফতার আতঙ্ক রয়েছে তৃণমূলে। এখনো প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না মাঠের নেতা-কর্মীরা। আবার মামলার আসামি হলে দল থেকে কর্মীরা কোনো ধরনের সাপোর্ট বিশেষ করে আইনি সহায়তা পান না বললেই চলে। সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ছে সাংগঠনিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও। বিএনপির আইনজীবীরা দাবি করেন, সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অন্তত পাঁচ লাখের বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। মামলা-হামলার ভয়ে আতঙ্কিত নেতা-কর্মীরা এখনো আত্মগোপনে। এসব মামলায় দেশজুড়ে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে এখনো কারাগারে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার  মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, শমসের মবিন চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, শামসুজ্জামান দুদু, রুহুল কবির রিজভী, নাদিম মোস্তফা, বেলাল আহমেদ, মাহবুবুল হক নান্নু, আবদুল মতিন প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন  খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নতুন নতুন মামলায় জড়াচ্ছে। এসব ‘মিথ্যা’ মামলায় আবার চার্জশিটও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ন্যায়বিচার পেলে কোনো মামলাই উচ্চ আদালতে টিকবে না। আব্বাসসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র : গাড়ি ভাঙচুর ও হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর হাকিম এস এম আশিকুর রহমানের আদালতে গতকাল বিকালে রামপুরা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মামুনুর রশিদ অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান ও নিখোঁজ সালাহউদ্দিন আহমেদসহ ৩৭ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় বিএনপি-জামায়াতের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি পালনের সময় ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটনায় মানসুর প্রধানিয়া নামে একজন মারা যান। ৩০ ডিসেম্বর ওই ঘটনায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) আল মামুন বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।
 

সর্বশেষ খবর