রবিবার, ২৪ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
শোচনীয় শিক্ষা ব্যবস্থা (৫)

জিপিএ ৫ এখন মুড়ি-মুড়কি মেধায় শূন্য শিক্ষার্থীরা

জিপিএ ৫ এখন মুড়ি-মুড়কি মেধায় শূন্য শিক্ষার্থীরা

শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতি বছরই বাড়ছে ‘সরকারি সফলতা’। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকছে, তারাই শিক্ষা ক্ষেত্রে নিজেদের ‘কৃতিত্ব’ দেখাচ্ছে। আর এ কৃতিত্ব শুধু বছর বছর জিপিএ-৫-এর বাড়-বাড়ন্তের ক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীদের মেধার নয়। ফলে এ ‘কৃতিত্ব’ ফলাতে গিয়ে বারোটা বাজছে শিক্ষার্থীদের।
বিশ্লেষকদের মতে দিন দিন সরকারের পক্ষ থেকে পরীক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নের নীতি হচ্ছে ‘পানির মতো সহজ’ বা অন্য কথায় ‘লিখলেই নম্বর’। ফলে স্কুল, কলেজে পাবলিক পরীক্ষায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জিপিএ-৫ ও পাসের হার। ভালো, অপেক্ষাকৃত ভালো কিংবা খুব ভালো সবার কাছেই জিপিএ-৫ এখন মুড়ি-মুড়কি। এই তথাকথিত সর্বোচ্চ ভালো ফলাফলের সার্টিফিকেট নিয়ে সবাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেও পরবর্তীতে উচ্চতর শিক্ষা কিংবা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জাতি, অন্যদিকে সমৃদ্ধ সার্টিফিকেট অর্জন করেও চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে বহু তরুণ-যুবা।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “রাজনৈতিক বিবেচনায় ফলাফল তথা সরকারের পাসের হার বৃদ্ধি দেখানোর প্রবণতা ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে এই ‘পরিসংখ্যানের রাজনীতি’ বন্ধ করতে হবে। বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নয়নে তৃণমূল পর্যায় থেকে এমন কিছু কাজ করতে সক্ষম হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসনীয়।” আর সে কারণেই খ্যাতনামা এই কথাসাহিত্যিক মনে করেন, শিক্ষার সত্যিকারের মান উন্নয়নে এবং প্রকৃত মেধাবীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সরকারের উচিত পাসের হারের এই রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসা। সংশ্লিষ্ট তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পরীক্ষায় জ্যামিতিকহারে বাড়ছে পাসের হার। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকছে সবাই এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটিতে নিজেদের সফল হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করছে। এমনকি অব্যাহত সফলতা প্রমাণ করতে শিক্ষককে সর্বোচ্চ নম্বর দিতেও প্ররোচিত করছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা খুব অল্প পড়াশোনা করেই ভালো নম্বর পাচ্ছে। ভালো ফলাফল করছে। সমৃদ্ধ সার্টিফিকেট অর্জন করেও তাদের ভিতরটা কেবল ফাঁপা-ই থেকে যাচ্ছে। এ প্রতিবেদন তৈরির সময় উচ্চমাধ্যমিকে (এইচএসসি) জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় কেমন ফলাফল করে- এ-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য দিক পাওয়া যায়। সেখানে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে ক, খ ও গ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় যথাক্রমে ৫২, ৫৩ ও ৫৫ শতাংশ জিপিএ-প্রাপ্তরা ফেল করেছে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া দূরে থাক, ভর্তি পরীক্ষায়ই ফেল করছে এই শিক্ষার্থীরা। এ ব্যাপারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি নির্দ্দিষ্ট মান ধরে রাখে বলেই ভালো ফলাফল করা অনেক শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হতে এসে অকৃতকার্য হয়। অন্যদিকে চাকরিদাতা বহু প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, সর্বোচ্চ রেজাল্ট নিয়ে এলেও চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের কাজের জন্য নিয়োগ দিতে পারছে না তারা।
কেননা তাদের চাকরির পরীক্ষায় বেশির ভাগেরই যোগ্যতার প্রমাণ মেলে না। বিশেষ করে করপোরেট হাউসে চাকরির ক্ষেত্রে একজন সত্যিকারের মেধাবী খুঁজে পাওয়া কঠিন। আপাতদৃষ্টিতে ভালো ফলাফলের সার্টিফিকেট দেখে যোগ্য এবং মেধাবী মনে হলেও ইন্টারভিউ কিংবা পরবর্তীতে ইন্টার্নশিপের সময় তাদের আসল সত্য বেরিয়ে আসে। ভালো ফলাফলের পেছনে প্রশ্নপত্র ফাঁসকেও অনেকে দায়ী করছেন। সাম্প্রতিককালে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন একাডেমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অনেকে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। গত ১০ বছরের এসএসসি, এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে পাঁচ বছর মেয়াদি যেকোনো সরকারের শেষ দুই বছরে ফলাফলে অভাবনীয় রেকর্ড। আর প্রতি বছরই বেড়েছে জিপিএ-৫ ও পাসের হার। পাসের হার গাণিতিকহারে বাড়লেও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বেড়েছে জ্যামিতিকহারে।

সর্বশেষ খবর