থাই সীমান্তের কাছে মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলে ২৮টি পরিত্যক্ত বন্দীশিবিরে ১৩৯টি গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর তা থেকে লাশ উত্তোলনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার পুলিশ। এরই মধ্যে তারা সেসব পরিত্যক্ত বন্দীশিবিরে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছে। দেশটির একটি আন্তসরকারি সংস্থা গতকাল বলেছে, এখানে শত শত ব্যক্তিকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করছে তারা। খবর রয়টার্সের। মালয়েশিয়ার সরকার বলেছে, এটি তদন্তাধীন রয়েছে যে বন্দীশিবিরগুলোয় অভিবাসীদের আটকে নির্যাতনের সঙ্গে স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তারা জড়িত কি না। থাইল্যান্ডের দক্ষিণে ও মালয়েশিয়ার উত্তরে ঘন জঙ্গলে বাংলাদেশি ও নিপীড়নের শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের এনে বন্দীশিবিরে রাখা হতো। এ এলাকাটি ছিল যাত্রাবিরতির জায়গা। এখানে আটকে রেখে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পরিবারের কাছে তাদের দিয়ে ফোন করানো হতো মুক্তিপণের জন্য। মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ গতকাল একদল সাংবাদিককে সেসব পরিত্যক্ত বন্দীশিবিরের একটিতে নিয়ে যায়, যেখানে একটি সংকীর্ণ নালা পার হয়ে খাড়া হয়ে নেমে গেছে। অত্যন্ত জীর্ণ একটি রাস্তা চলে গেছে, যেখানে মূল সড়ক থেকে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যায়। সেখানে পৌঁছার পর রয়টার্সের এক সাংবাদিক দেখতে পান বিকালের দিকে প্রথম কোনো মৃতদেহকে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে। আগের দিন সোমবার মালয়েশীয় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পেরলিস অঙ্গরাজ্যে সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে তারা ১৩৯টি গণকবরের সন্ধান পেয়েছে, যেখানে ২৮টি বন্দীশিবির ছিল।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা আইএমওর মুখপাত্র জোয়েল মিলম্যান জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, কয়েক দিনের মধ্যেই সেখান থেকে শতাধিক মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হবে।’
এদিকে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে মানব পাচারকারীদের ধরতে যে অভিযান চলছে, তা আদৌ কার্যকর হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আন্দামান সাগরে মানব পাচারের শিকার কয়েক হাজার বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গার আটকে পড়ার পটভূমিতে কক্সবাজারসহ আশপাশ এলাকায় অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। বলা হচ্ছে, মানব পাচারের পেছনে রয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। স্থানীয় দালালদের দিয়ে তারা কাজ করিয়ে নিচ্ছেন এবং প্রভাবশালী গডফাদাররা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এদিকে রয়টার্সকে থাইল্যান্ডের প্রাদেশিক পুলিশ উপপ্রধান ফটিচার্ট ইকাচান বলেন, ‘আমরা জানি না, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় খোঁজ মেলা বন্দীশিবিরগুলোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না। তবে এটি হতে পারে, থাই কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কঠোর হওয়ার পর কিছু বন্দীশিবির সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানকার কিছু বন্দী অভিবাসী পালিয়ে গেছে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায়। এটি হতে পারে তবে আমরা এ বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত নই।’
জোয়েল মিলম্যান বলেন, সবচেয়ে বড় বন্দীশিবিরটিতে এক হাজারের মতো লোককে আটকে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘যদি পরিবারের পক্ষ থেকে মুক্তিপণ পৌঁছে দেওয়া না হতো, তবে আটকে রাখাদের ওপর নেমে আসত অবর্ণনীয় নির্যাতন, শিকলে বেঁধে প্রহার আর খাবারের বঞ্চনা।’
মালয়েশিয়ার পুলিশপ্রধান খালিদ আবু বকরের উদ্ধৃতি দিয়ে দেশটির বার্তা সংস্থা বেরনামা বলেছে, বন্দীশিবিরগুলো ২০১৩ সালে চালু করা হয়েছিল। আর এর মধ্যে দুটি বন্দীশিবির মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে ছেড়ে যায় মানব পাচারকারীরা। খালিদ বলেন, পুলিশ এসব বন্দীশিবিরের হিংস তা বিষয়ে ব্যথিত।
কুকর্মে সহযোগিতা : গণকবরের সন্ধান মেলায় মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড উভয় দেশের সীমান্তবর্তী সরকারি কর্মকর্তাদের কুকর্মের সহযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গতকাল মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে পাচারকারী চক্রকে বন বিভাগের কর্মকর্তারা সহযোগিতা করতেন বলে বেরিয়ে এসেছে। এ ছাড়া কিছু পুলিশ সদস্যও এসব বন্দীশালায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আটকে রাখতে সহায়তা করেছেন। তিনি সংসদে বলেন, ‘আমরা সন্দেহ করছি তাদের মধ্যে কিছু কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত।... কিন্তু আমরা বন বিভাগের ওপর কিছু শর্ত জুড়ে দিতে কাজ করছি।’
রয়টার্সের প্রতিনিধি গতকাল বন্দীশিবিরগুলো ঘুরে দেখার সময় লক্ষ্য করেছেন, সেখানে বিভিন্ন স্থানে থরে থরে সাজানো ছিল বাঁশ এবং এর ওপর ত্রিপল বাঁধা ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ সময় এক পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বলেন, একেকটি বন্দীশিবিরে ৪০০ জন ভাগ্যহতকে পর্যন্ত রাখা হতো। সেখানে একটি বড় প্লাস্টিকের ট্যাঙ্ক দেখা গেছে। পুলিশ বলেছে, নির্যাতনকারীরা বন্দীদের নির্দয়ভাবে পেটাত। নির্যাতনের জায়গাটি কাঁটাতারের বেড়ায় ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি খাঁচায় তাদের আটকে রাখা হতো, যা এতটাই ছোট ছিল যে ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা যেত না।
একজন কর্মকর্তা বলেন, ৩৭টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে সেখানে, যা থাইল্যান্ডের সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েকশ’ মিটারের মধ্যে। যখন পুলিশ সেখানটা খুঁড়তে আরম্ভ করল, কবরের গভীর থেকে শরীর আবৃত করার পোশাকের একটা বড় অংশ বেরিয়ে এলো, যা ছিল সুতিকাপড়ের।
মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী বাসিন্দা ওয়াং কেলিয়ান বলেন, তারা এমন বহু অভিবাসনপ্রত্যাশীকে তাদের এলাকায় দেখেছেন। পার্শ্ববর্তী এক হোটেলমালিক আবদুর রহমান মাহমুদ বলেন, ‘তাদের দেখে বোঝা যেত যে তারা অনাহারী। কয়েক সপ্তাহ ধরে খাবারবিহীন। তারা খাওয়ার জন্য এমনকি বীজ বা পাতা খুঁজত। এটিই বাস্তবতা এবং এটি চোখে পড়া অত্যন্ত দুঃখজনক।’