দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে চলমান অভিবাসন সংকট সমাধান নিয়ে আলোচনা গতকাল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে শুরু হয়েছে। যে দেশটির প্রতি অভিবাসন সংকট সৃষ্টির অভিযোগের তীর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সেই মিয়ানমারও বৈঠকে যোগ দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে জাতিসংঘ মিয়ানমারকে এ সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। তবে দেশটি জানিয়ে দিয়েছে, এ সংকটের দায়ভার তাদের একার নয়। তাদের দিকে অভিযোগের তীর তাক করা যাবে না।
ব্যাংকক পোস্টের খবরে বলা হয়, বৈঠকে রয়েছে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইরান, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড। এ ছাড়া পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে আছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও সুইজারল্যান্ড।
গতকালের বৈঠক শেষে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্য জানানো হয়, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। অভিবাসী নিয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তারা এ সমস্যার সমাধানে মূল কারণ অনুসন্ধান করে সমাধান করবে। এটা কীভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়েও কাজ বরবে। বৈঠকে সমস্যা সমাধানে আট মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়। যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূলে অভিবাসন রোধে ব্যয় হবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ঘোষণা দিয়েছেন, সাগরে ভাসমান থাকা মানুষকে খুঁজতে তারা বিমান অনুসন্ধান চালাবে। বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক এ সমস্যার সমাধানে ২৩টি প্রস্তাবনা প্রস্তাব পেশ করেন। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা বলেন। তিনি অভিবাসীদের উদ্ধারের জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সরকারকে ধন্যবাদ জানান। শহিদুল হক বলেন, হাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আটকেপড়া বাংলাদেশিদের পরিচয় শনাক্তে কাজ করছে সরকার। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর আগামী এক মাসের মধ্যে এসব বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত নেওয়া হবে বলেও জানান। চলতি মাসের শুরুতে নিজেদের সীমান্তে অভিবাসন প্রত্যাশীদের ৩২টিরও বেশি কবরের সন্ধান পায় থাইল্যান্ড। এরা সবাই মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা মুসলমান ও উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু বাংলাদেশি নাগরিক। এরপরই মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় থাইল্যান্ড। মানব পাচারকারীরা এরপর অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকায় খাদ্য ও পানীয়বিহীন অবস্থায় থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া উপকূলে ফেলে রেখে চলে যেতে শুরু করে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া প্রায় আড়াই হাজার অভিবাসন প্রত্যাশীকে সাময়িক আশ্রয় দিলেও সাগরে ভাসমান অন্যদের উদ্ধারে অস্বীকার জানায়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এখনো সাগরে তিন হাজারের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে দেশ দুটি। অভিবাসন প্রত্যাশীদের এই সংকট নিরসনে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সম্মেলনের ডাক দেয় থাইল্যান্ড। গতকাল ব্যাংককে ভারত মহাসাগরে অনিয়মিত অভিবাসন প্রত্যাশীদের যাতায়াতের কারণে প্রভাবিত দেশগুলো বৈঠকে বসে। বৈঠকে যোগ দিতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএন এইচসিআর, জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা তাদের কর্মকর্তাদের পাঠায়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বলেছে, বৈঠকে যোগ দেওয়া দেশগুলো অনিয়মিত অভিবাসন ঠেকাতে ভারসাম্যপূর্ণ উপায় খুঁজছে। সংস্থাটির পরিচালক উইলিয়াম লেসি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী সমস্যা ভূমধ্যসাগরের সমস্যার চেয়ে ভিন্ন। সম্প্রতি সাগরে আটকেপড়া লোকজন প্রসঙ্গে লেসি বলেন, সবচেয়ে জরুরি ছিল নৌযানে থাকা তিন হাজার ৯০০ জনকে উদ্ধার করা। আইওএমের প্রধান গতকালের বৈঠকটিকে ২০ মে মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের ফলোআপ হিসেবে দেখছেন। তিনি আশা করছেন, ব্যাংককে বৈঠকের পরও অভিবাসী সংকট নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। উইলিয়াম লেসি জানান, খুব শিগগিরই তারা আরও একটি বৈঠক মালয়েশিয়ায় করতে যাচ্ছেন। বৈঠকের শুরুতে থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী তানাসাক পাতিমাপ্রাগো বলেন, অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীদের ঢল আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘যে মূল কারণ এই লোকগুলোকে দেশত্যাগে প্রভাবিত করছে, সেগুলোকে অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে।’ তার সঙ্গে সুর দিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার ভল্কার তার্ক বলেন, অভিবাসন সংকটের মূল কারণ চিহ্নিত না করা গেলে এ সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। এ জন্য তিনি মিয়ানমারের কাঁধেই দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এ জন্য মিয়ানমারকে তার জনগণের পুরো দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া অবশ্যই উচিত। জাতিসংঘের এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে মিয়ানমার। দেশটি সাফ জানিয়ে দেয়, অভিবাসন সংকটের দায় তাদের একার নয়। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিতন লিন বলেন, ‘গোটা অঞ্চলটিই মানব পাচারের সমস্যায় জর্জরিত। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিয়ানমার অন্যান্য আঞ্চলিক দেশের সঙ্গে এবং আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করে যাবে।’ উল্লেখ্য, রোহিঙ্গারা বহু বছর ধরে মিয়ানমারে বাস করে এলেও তাদের মৌলিক অধিকার ও নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে আসছে দেশটি। এ কারণে দেশটিতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যেরও শিকার হচ্ছে। এসব সমস্যার মূল কারণ উদঘাটন করে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। বিশ্বের অনেক দেশের নেতা মিয়ানমারকে এ সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
মিয়ানমার উপকূলে ৭২৭ অভিবাসী উদ্ধার : বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার উপকূল থেকে ৭২৭ অভিবাসী উদ্ধার করেছে দেশটির নৌবাহিনী। এদের ‘বাঙালি’ বলে দাবি করছে স্থানীয় সরকার। দেশটির তথ্য মন্ত্রণালয় ও নৌবাহিনী সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম গতকাল এ খবর জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বলছে, উদ্ধার অভিবাসীদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা বলে মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি সৃষ্ট অভিবাসী সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে যখন এ বিষয়ে আঞ্চলিক সম্মেলন চলছে, ঠিক তখনই এই অভিবাসী উদ্ধারের খবর এলো। এএফপি, বিবিসি, আল জাজিরা