বুধবার, ১৭ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা

ফোনে আড়িপাতা আতঙ্কে বিএনপি

ফোনে আড়িপাতা আতঙ্কে বিএনপি

দুঃসময় বুঝি আর বিএনপির পিছু ছাড়ছে না। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলে এমনিতেই বিপর্যস্ত এক সময়ের ক্ষমতাসীন দলটি। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফোনে ‘আড়িপাতা আতঙ্ক’। দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফোনালাপ ফাঁসে নতুন করে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে তারা। অনেক নেতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও পড়ছে হুমকির মুখে। নেতাদের কথাবার্তায় দলের ভিতরে-বাইরের দুর্বলতাও প্রকাশ পাচ্ছে। এ নিয়ে আতঙ্কে এখন দলের সিনিয়র নেতারা। অনেকেই এখন মোবাইল ফোনে কথা বলতেও অপারগতা প্রকাশ করছেন। বিব্রত ও অস্বস্তিতে খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির চার সদস্যসহ বেশ কয়েকজন নেতার ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়। এতে দলের সর্বস্তরে নেতা-কর্মীর মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। দলীয় প্রধান সম্পর্কে সিনিয়র নেতাদের মূল্যায়নে ক্ষুব্ধ মাঠের নেতা-কর্মীরা।
টেলিফোনে আড়িপাতা প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে শুধু এটুকুই বলেন, ‘এটা গুরুতর অন্যায়। এটা আইন সিদ্ধ নয়।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘শুধু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকি ছাড়া কারও ব্যক্তিগত ফোনে আড়িপাতার বিধান নেই। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কারও ফোনে আড়ি পেতে থাকলেও তা প্রকাশ করা যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলের যেসব নেতার ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে, তার দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। যদি সরকার বা রাষ্ট্র এ ধরনের আড়ি পেতে না থাকে তাহলে কারা করছে তাও খুঁজে বের করার দায়িত্বও সরকারের।’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধনী) আইন-২০০৬ এ সরকারকে টেলিফোনে আড়িপাতার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে এ আইনের ৯৭-ক ধারায় বলা হয়, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের জন্য সরকার গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দিতে পারবে। তবে আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির ফোনে আড়ি পাততে হলে অবশ্যই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি নিতে হবে।’ বিএনপির অভিযোগ-বিরোধী দলকে দুর্বল করতেই সরকার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ফোনে আড়ি পাতছেন। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ানোর অপচেষ্টা চলছে। দল ভাঙা-গড়ার চিন্তা করছে ক্ষমতাসীনরা। ব্যক্তিগত ফোনে এভাবে আড়িপাতা আইনগতভাবেও অনুচিত। সরকার অসৎ উদ্দেশ্যেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। তাছাড়া শুধু বিরোধী দল-মতের ফোনালাপ ফাঁস করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়নি। গত দুই বছরে ধারাবাহিকভাবে বিএনপির অন্তত দেড় ডজন শীর্ষ নেতার ফোনালাপ ফাঁস করা হয়। এ ছাড়াও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সরকারবিরোধী নেতাদের ফোনালাপেও আড়িপাতা হয়। পরে তা ফাঁসও করে দেওয়া হয়। এ জন্য তাকে জেলও খাটতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতারা এখন ফোনালাপে খুবই সতর্ক। এমনকি গণমাধ্যমের সঙ্গেও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কথা বলছেন তারা। ফোনালাপ ফাঁসের প্রথম ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর। উত্তপ্ত রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফোন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের মধ্যে প্রায় ৩৭ মিনিট কথোপকথন হয়। একদিন পরেই একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ওই কথোপকথনটি সম্প্রচার করে। এ ঘটনার পর দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এর আগে ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীতে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের প্রস্তুতি হিসেবে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে খালেদা জিয়া মোবাইল ফোনে নানা দিকনির্দেশনা দেন। ওই ফোনালাপের পাঁচটি অডিও ফাঁস হয় ইউটিউবে ‘বাংলালিক’ নামে। ফোনালাপ ফাঁসের শিকার হন বিএনপি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান ফোন দিয়েছিলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীকে। প্রায় ১০ মিনিটের কথোপকথনের পরপরই তা ইউটিউবে ফোনালাপটি ফাঁস করা হয়। এতে দলের শীর্ষ নেতারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। ফোনালাপ ফাঁসের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে প্রায় ২৩ মিনিট ফোনে কথা বলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। সরকারবিরোধী আন্দোলন ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন তারা। কয়েকদিন পরই তাদের ফোনালাপ ফাঁস করে দেওয়া হয়। ওই ফোনালাপে সেনাবাহিনীকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ এনে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয় মান্নাকে। ওই ঘটনায় এখনো কারাভোগ করছেন মান্না। গত বছর নারায়ণগঞ্জে অপহরণ করে সাত খুনের মামলার পলাতক প্রধান আসামি নূর হোসেনের সঙ্গে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ফোনালাপও ফাঁস হয়ে গণমাধ্যমে চলে আসে। যেখানে নূর হোসেনকে পালিয়ে যেতে বলেন শামীম ওসমান। এতে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। সর্বশেষ ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় বিব্রত বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিন সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ও ড. আবদুল মঈন খান। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের এক নেতার সঙ্গে ফোনালাপে ফেঁসে যান ড. আবদুল মঈন খান। যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা রইস উদ্দিনের সঙ্গে জেনারেল মাহবুবুর রহমানের ফোনালাপেও বিব্রত নেতা-কর্মীরা। এর আগে ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের সঙ্গে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ফোনালাপ ফাঁসেও তোলপাড় সৃষ্টি হয় দলের ভিতরে-বাইরে।

সর্বশেষ খবর