মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

কংক্রিটে রাস্তা নির্মাণে মানা হচ্ছে না প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

কংক্রিটে রাস্তা নির্মাণে মানা হচ্ছে না প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

সিমেন্টের কংক্রিটে রাস্তা নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সড়ক-মহাসড়কের বিপর্যয় ঠেকাতে সারা দেশে বিটুমিনের পরিবর্তে সিমেন্টের রাস্তা নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনার পর পেরিয়ে গেছে ১৬ মাস। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) সিংহভাগ সড়কই এখন ঝুঁকির মুখে। বৃষ্টি ও খানাখন্দে সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  দেশের সড়কগুলো বিটুমিনের প্রলেপে নির্মাণ করার কারণে এ পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে প্রতি বছর। কিন্তু সিমেন্ট ব্যবহার করে রাস্তা তৈরি করা হলে তা যেমন টেকসই হয়, তেমনি তা বর্ষায় পানি জমলেও নষ্ট হয় না। তাদের মতে, বিটুমিনের শত্রু পানি। আর সিমেন্টের কংক্রিটের রাস্তায় পানি পড়লে তা হয় আরও দৃঢ়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সম্প্রতি এক বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী সস্তার দোহাই না দিয়ে বিটুমিনের পরিবর্তে দীর্ঘস্থায়ী পেভমেন্ট তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন। বিটুমিনে সড়ক তৈরি কংক্রিটের তুলনায় সাশ্রয়ী হলেও এ প্রক্রিয়ায় রাস্তা বার বার সংস্কার করতে হয়। যেহেতু আমরা ধনী দেশ নই, সে কারণে মেরামতের নামে ঘন ঘন সড়ক সংস্কার আমাদের ব্যয় বৃদ্ধি করছে। অথচ রিজিড পেভমেন্টে সড়ক নির্মাণ করা হলে তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হবে। আর কংক্রিটে তৈরি রাস্তা পানির শত্রু নয়, বিটুমিন পানির শত্রু। বিটুমিনের তৈরি করা রাস্তায় পানি জমে তার ওপর যদি অতিরিক্ত ভারবোঝাই ট্রাক চলাচল করে তবে সে রাস্তা যত শক্তিশালীভাবেই তৈরি করা হোক না কেন তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন রাস্তায় বড় বড় গর্ত তৈরি হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রাজধানীর সব রাস্তা ক্রমান্বয়ে বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিট দিয়ে নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সংস্কারের ঝামেলা কম থাকায় এবং দীর্ঘস্থায়ী ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি হওয়ায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে সূত্রটি জানায়। সূত্রমতে, পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনের রাস্তাটির কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। শেরেবাংলানগর নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সামনে থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল পর্যন্ত, অন্যদিকে গণভবনের সামনের রাস্তা হয়ে মিরপুর রোড পর্যন্ত সড়কটি এ প্রকল্পের আওতায় নেওয়া হয়েছে। দু-এক সপ্তাহের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলেও জানা গেছে। জানা যায়, গত বছর ১০ মার্চ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তার সহকর্মীদের বলেন, ‘বিটুমিনের প্রলেপে নির্মাণ করার কারণে আমাদের দেশের মহাসড়ক প্রতি বছরই মেরামত করতে হয়। অথচ পাথর, বালু ও সিমেন্টের কংক্রিট দিয়ে মহাসড়ক তৈরি করলে বেশি দিন টেকে। যদি কংক্রিটের রাস্তা বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে আমাদের সেদিকেই যাওয়া উচিত। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচুর সিমেন্ট উৎপাদন হচ্ছে। এ সিমেন্ট বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দেশের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য এ বিষয়ে এলাকাভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির নির্দেশ দেন।
সড়ক প্রকৌশলীদের মতে, বাংলাদেশের জলবায়ু, প্রচুর বৃষ্টিপাত, বন্যা, জলাবদ্ধতাসহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে সড়কব্যবস্থা দ্রুত বিনষ্ট হচ্ছে। সড়কে ফাটল, ছোট-বড় গর্ত, বিটুমিন উঠে ইট-পাথর বেরিয়ে পড়াসহ বিভিন্ন কারণে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এসব প্রেক্ষাপটে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) দেশের মোট ২১ হাজার ৪৮০.২৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১৪ হাজার ৬৫২ কিলোমিটারে একটি পর্যবেক্ষণ ও জরিপ করে। এতে দেখা যায়, ৩ হাজার ৫৩৩ কিলোমিটার সড়কই যান চলাচলের একেবারে অনুপযোগী, ৭ হাজার কিলোমিটার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি অংশের অবস্থাও ভালো নয়। সড়কের এ বিপর্যয়ের কারণে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে জীবন ও সম্পদহানি। এ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই দেশের সড়ক নির্মাণে প্রচলিত নির্মাণ কৌশল থেকে বেরিয়ে আধুনিক, বিশ্বমানের ও টেকসই সড়ক নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানান প্রকৌশলীরা। সূত্র জানায়, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয়ও একই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা বিটুমিন প্রথা ছেড়ে সড়ক নির্মাণে ব্যবহার করছেন কংক্রিট । এ সড়ক প্রচলিত বিটুমিন সড়কের তুলনায় অনেক বেশি টেকসই এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিকভাবেও সাশ্রয়ী।
সূত্র জানায়, বিটুমিনের সড়কের স্থায়িত্বকাল ২০ বছর বলা হলেও অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচলের কারণে দুই/এক বছর, আর বেশির ভাগ সড়কই পাঁচ বছরের মধ্যেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। অথচ আগে সড়ক নির্মাণে বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিটই ব্যবহৃত হতো, যা স্থায়িত্বেও ছিল অনন্য। প্রকৌশলীরা জানান, একসময় বাংলাদেশে সিমেন্ট আসত দুটি দেশ থেকে। ফলে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করাও ছিল বেশ ব্যয়সাধ্য। সিমেন্ট সংকট ও পশ্চিমা দাতাদের চাপে বাধ্য হয়েই এ দেশের সড়কে বিটুমিন ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে সিমেন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশ শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, সিমেন্ট রপ্তানিও হচ্ছে। তাই সড়ক নির্মাণে কংক্রিটের ব্যবহারই বিটুমিনের শৃঙ্খল থেকে বেরোবার কার্যকর উপায়।
সড়ক প্রকৌশলীদের মতে, পিচ মিশ্রিত বিটুমিন সড়কের চারটি স্তর থাকলেও তা শুধু ওপরের স্তরকেই আঁকড়ে রাখতে পারে; কিন্তু রিজিড পেভমেন্টের কংক্রিট তার সব উপাদানের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করে বলে অবকাঠামো সহজে নষ্ট হয় না। যেমন একটি সড়ক দ্রুত নষ্ট হলেও ওই সড়কেরই একটি সেতু কংক্রিট নির্মিত বলে ৩০-৪০ বছর পেরোলেও তেমন ক্ষতি হয় না।
রাজধানীতে গত কয়েক বছরে ডিসিসি অল্প কিছু রাস্তা কংক্রিটে নির্মাণ করেছে, যা বর্তমানে ভালো অবস্থায় রয়েছে। জানা গেছে, বিটুমিনে ব্যবহৃত কালো রঙা পিচ সাধারণত অশোধিত পেট্রোলিয়ামের উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য থেকেই তৈরি হয়। এতে পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষাক্ত হাইড্রোকার্বন থাকে। পিচ উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন এবং ব্যবহারের সময় বাতাসে প্রচুর হাইড্রোকার্বন ছড়ায়। আর এ বিষাক্ত উপাদান পাথরে মিশিয়ে সড়ক নির্মিত হয়। অথচ এটা মানবদেহ, প্রাণীকুল ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মূলত প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনার পরই সিমেন্টের তৈরী রাস্তা নির্মানের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। প্রথম পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা গবেষণার কথা বলা হলেও হালে সেই নির্দেশণা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেড় দেখা যায়নি। অথচ বিশেষজ্ঞরা সিমেন্টের তৈরী সড়ক নিমার্নেই গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক তার ‘ইভালুয়েশন অব ফ্লেক্সিবল অ্যান্ড রিজিড পেভমেন্ট কনষ্ট্রাকশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এক গবেষণাপত্রে দেখান, রিজিড পেভমেন্টই সময়োপযোগী ও সময় সাশ্রয়ী। এলজিইডিডি’র সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান বলেন, ৬০ দশকের তৈরী করা ক্রংক্রিট ব্যবহারের রিজিড পেভমেন্ট প্রযুক্তির সড়ক ৭০ দশকেও কিছু হয়নি এ দেশে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। শুরু হয় বিটুমিনে পেভমেন্ট নির্মাণ। ফলে পাঁচ দিন পানি জমে থাকলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিচ উঠে যায়। সৃষ্টি হয় ছোট-বড় গর্ত।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদি আহমেদ আনসারি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমেরিকাসহ বিশ্বের সকল উন্নত দেশে রাস্তা কংক্রিটের তৈরি। এগুলো টানা ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। 

সর্বশেষ খবর