শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিনিয়োগে পদে পদে বাধা

রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও দেশে এখনো বিনিয়োগে পদে পদে বাধা। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। তবুও বিনিয়োগ আকর্ষণে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে গিয়ে পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তির মুখে পড়তে হতে হচ্ছে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের। দেশে এখনো নেই কোনো ওয়ানস্টপ সার্ভিস। গ্যাস সংযোগ নেই। বিদ্যুতের চাহিদাও মিটছে না। পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে ভোগান্তি তো আছেই। সব মিলিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শিকার দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের অবস্থা এখন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’। সরকারি দফতর থেকে দফতরে ঘুরে ক্লান্ত উদ্যোক্তারা এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য জ্বালানি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ নিয়ে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। সরকার জ্বালানি সমস্যা সমাধানের নিশ্চিয়তা দিলে বিনিয়োগের অভাব হবে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শিল্প প্রতিষ্ঠায় যেসব সুযোগ-সুবিধা চান, সরকার তা দিতে পারে না। যেমন- বিনিয়োগকারীরা জমি চাইলে তা সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে পারে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, অবকাঠামোসহ অন্যান্য সমস্যা তো লেগেই আছে। দুর্নীতি, সুশাসন ও আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের সমস্যাও রয়েছে। ব্যবসায়ীদের জন্য সব প্রয়োজনীয় সেবা দেবার জন্য নেই ওয়ান স্টপ সার্ভিস সুবিধা। বিনিয়োগ বোর্ড কেবল নিবন্ধনের কাজটুকু করেই খ্যান্ত। সেখানে বিনিয়োগকারীদের নিবন্ধনের হয়রানি সামলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতরসহ একাধিক স্থান থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লাগে। চট্টগ্রামের কোরিয়ান ইপিজেডের পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে সময় লেগেছে প্রায় ১১ বছর। এ ধীরগতির কারণে কেইপিজেডে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইয়াং ওয়ান করপোরেশন বিনিয়োগ না করে, তা নিয়ে গেছে ভিয়েতনামে। কেননা- ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ভারতের মতো অনেক দেশে কম সময়ে নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করা সহজ। ফলে ধীরগতি ও হয়রানির কারণে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তবে বর্তমান সরকার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে চীনে। প্রতিষ্ঠানগুলো চীনে শিল্প স্থাপন করে পুনঃরপ্তানি সুবিধা কাজে লাগাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৫ জুন বাংলাদেশ সফরে এসে পোশাকশিল্প উদ্যোক্তাদের মাত্র ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব লুফে নিতে এক সেকেন্ডও সময় নেননি। দেশে ফিরে মাত্র সাত দিনের মাথায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য জমি বরাদ্দের ফিরতি বার্তাও পাঠিয়েছেন। মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম বিনিয়োগ আকর্ষণে সব সুযোগ-সুবিধার পসরা সাজিয়ে বসে আছে। সে দেশের বিমানবন্দরে যে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী পৌঁছা মাত্রই তাকে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানানো হয়। সেখানে ঢাকায় বিমানবন্দরে নেমে একজন বিদেশি যে হয়রানির শিকার হন, তা চলে তোপখানা রোড হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত।  আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতাও বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। প্রশাসন-আমলাতন্ত্রের এমন মারপ্যাচেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিদেশি বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ফিকি) সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে গ্যাস ও অবকাঠামো খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে। কেউ কেউ পুনঃরপ্তানির জন্যও বিনিয়োগ করতে আসতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ না আসার জন্য দায়ী পর্যাপ্ত অবকাঠামো সংকট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। জমি নিয়ে জটিলতার সঙ্গে আছে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট। এসব সমস্যা মোকাবিলা করে বাংলাদেশে ম্যানুফেকচারিং হাব বা প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, তারও উত্তর খুব সহজে মিলেছে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট পোস্টমটেমে। অর্থমন্ত্রীর বাজেটে বিনিয়োগ প্রসঙ্গ আছে যৎসামান্য। প্রত্যাশিত রাজনৈতিক স্থিতি সামনের দিনগুলোতে বিনিয়োগ পরিবেশে অর্থবহ পরিবর্তন আনবে এবং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ চাঙ্গা হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে অর্থমন্ত্রী দুষেছেন রাজনীতিকেই। এ জন্য তিনি বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে বলেছেন, ২০-দলীয় জোটের ধ্বংসযজ্ঞ অর্থনীতির সাবলীল গতিকে ধ্বংস করেছে। তবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন, রপ্তানি বাড়ানো ও বহুমুখীকরণকে উৎসাহিত করতে দেশের সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারত থেকে আসা অনেক বড় ধরনের বিনিয়োগ উদ্যোগ জমির অভাবে বাস্তব রূপ পায় না। তবে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ভূমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও যোগাযোগ অবকাঠামো সুবিধা ব্যবসায়ীদের দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) ‘বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০১৪ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ কমেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে নিট ১৫২  কোটি ৬৭ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা ২০১৩ সালে ছিল ১৫৯ কোটি ৯১ লাখ ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে উপার্জিত আয়কে পুনঃবিনিয়োগ করার মাধ্যমে। এভাবে বিনিয়োগ হয়েছে ৯৮ কোটি ৮৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এ ছাড়া ‘ইক্যুইটি’ বা নিজস্ব মূলধন এসেছে ২৮ কোটি ৩ লাখ ১০ হাজার ডলারের। আন্তঃকোম্পানি ঋণের মাধ্যমে এসেছে ২৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।

সর্বশেষ খবর