শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

তিন দ্বন্দ্বে তিন খুন

পশুর হাটের ইজারা, নতুন নেতৃত্ব, ঝুট ব্যবসা

তিন দ্বন্দ্বে তিন খুন

গুলিতে নিহত ফিরোজ আহমেদ মানিকের মেয়ে ও ভাতিজির আহাজারিতে গতকাল হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয় বাড্ডার বাসায়

পশুর হাটের ইজারা, নতুন নেতৃত্ব ও ঝুট ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুই নেতাসহ তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে। হত্যার পেছনে চাঁদাবাজি, অবৈধ বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকতে পারে বলেও জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে ছয় যুবক অংশ নেয়। এদের মধ্যে তানভীর, হেলাল ও শুভকে শনাক্ত করা গেছে। যারা এলাকার দুর্ধর্ষ মাহবুব ও ডালিম গ্রুপের সদস্য। তবে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কোন্দলের কোনো ঘটনা নেই। জাতীয় শোক দিবসকে ভণ্ডুল করতে প্রতিপক্ষ এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে মধ্য বাড্ডার আদর্শনগর পানির পাম্পে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শামসুদ্দিন মোল্লা (৫০) ও স্থানীয় আল-সামি হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ফিরোজ আহমেদ মানিক। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ওরফে গামা (৪০) গতকাল সকাল ৯টার দিকে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। একই ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন গ্যারেজ মালিক আবদুস সালাম। জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে আদর্শনগর পানির পাম্পের রুমে শাসমু, গামা, মানিক, সালাম, হারুন-অর-রশিদ, ফারুক, তৌফিকসহ বেশ কয়েকজন জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি নিয়ে মিটিং করেন। মিটিং শেষে পাম্পের খালি মাঠে থাকা চারটি চেয়ারে শামসু, গামা, মানিক ও সালাম বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। তাদের চেয়ারের পেছনে আরও তিন-চার জন দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর হারুন, ফারুক ও তৌফিক রুম থেকে বেরিয়ে ওদের সঙ্গে মাঠে অবস্থান না করে চলে যান। তারা চলে যাওয়ার ৫-৭ মিনিটের মাথায় তিন-চার জন যুবক এসে শাসমু, গামা, মানিক ও সালামদের এলোপাতাড়ি গুলি করে পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী ওই পাম্পের অপারেটর মিজানুর রহমান বলেন, ৯টার দিকে ২০-২১ বছর বয়সী তিন-চার জন যুবক শামসু, গামাদের লক্ষ্য করে ৭-৮ রাউন্ড গুলি করে। গুলির আওয়াজ শুনে সবাই দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে থাকে। পাম্পের সামনের দোকানিরা তৎক্ষণাৎ দোকানের শাটার বন্ধ করে যে যার মতো চলে যান। মিজান জানান, গুলির শব্দ শেষ হয়ে গেলে তিনি ঘটনাস্থলে এসে পাম্পের পাইপের পাশে একজনকে উবুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি হাত দিয়ে টেনে দেখেন পাম্পের পাশের আল-সামি হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মানিক। এ সময় আশপাশের লোকজন তাকে আল-সামি হাসপাতালে নিলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি জানান, এর আগে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শাসমু, গামা ও সামাদকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক শাসমুকে মৃত ঘোষণা করেন। স্থানীয় অনেকেই বলছেন, অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি করে যাওয়ার সময় কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। এতে কেউ ভয়ে তাদের ধরতে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ঘটনার দিন মিটিং শেষে চলে যাওয়া ওই তিন-চার জন যুবক গাঢাকা দিয়েছেন। তবে এ হামলার মূল লক্ষ্য গামা ছিলেন বলে দাবি করছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও গামার সহযোগী তাহসীর রহমান সৈকত। আর গামাকেই প্রথমে গুলি করা হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। আমিনুর রহমান রিপন নামে গামার এক মামাতো ভাই বলেন, গামা গত বছর মেরুল বাড্ডায় কোরবানির পশুর হাটের ইজারা পেয়েছিলেন। এবারও তিনি হাট নেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। এ নিয়ে বিরোধ থেকে তাকে হত্যা করা হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। জানা গেছে, গামা তার স্ত্রী লিনডা ও ছয় বছর বয়সী একমাত্র ছেলে নিহাদকে নিয়ে আদর্শনগর ৪০ নম্বর রত্না ভিলার দ্বিতীয় তলায় থাকতেন। সোনার বাংলা সমাজকল্যাণ সংস্থা নামে তার একটি এনজিও রয়েছে। অন্য একটি সূত্র জানায়, গামা পশুর হাট নেওয়ার পর সেই ভাগবাটোয়ারা নিয়ে তার নিজ লোকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। এবারও গামা পশুর হাট ইজারা নেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছিলেন। তা মেনে নিতে পারেনি মাহবুব ও ডালিম গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরেই তারা গামাকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটছিল। নিহত শামসুদ্দিন মোল্লা একই এলাকার মোল্লাপাড়ায় স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকতেন। তার বাবার নাম মাহতাব উদ্দিন মোল্লা। শাসমু ১৯ বছর মালয়েশিয়া থাকার পর ২০০৮ সালে দেশে আসেন। এর পর থেকে বালুর ড্রেনেজের ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি রাস্তা নির্মাণের কাজের সঙ্গে জড়িত বলে জানান তার চাচা নুরুজ্জামান। তবে কারা, কী কারণে শামসুকে হত্যা করেছে তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এর পাশের আল-সামি হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ছিলেন মানিক। তবে তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। বন্ধুরা রাজনীতি করতেন তাই অফিস শেষে তাদের সঙ্গে পাম্পে বসে আড্ডা দিতেন। কিন্তু এ আড্ডাই যে তার কাল হবে, তা কে জানত। তাকে হারিয়ে পুরো পরিবার এতিম হয়ে গেছে। মাতম চলছে আদর্শনগরের অলিগলিতে।

নিহত মানিকের শালা একরামুল হক জানান, মানিকের স্ত্রীর নাম লায়লা আক্তার। দুই মেয়ে রুবি, জুমারা ও স্ত্রীকে নিয়ে শ-২৬/১ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকতেন। তবে এ হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত দাবি করে একরামুল হক বলেন, ‘আমার দুলাভাই তো রাজনীতি করতেন না, তাহলে তাকে কেন হত্যা করা হলো?’ দেখা যায়, বেলা ২টার দিকে ময়নাতদন্তের পর মানিকের লাশ বাসায় নিলে সেখানে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও হাসপাতালের কর্মচারীরা শেষবারের মতো দেখতে বাসার সামনে ভিড় করেন। তবে কেন এ হত্যাকাণ্ড, তা কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না।
জানা গেছে, একসময় বাড্ডা থানা এলাকায় আধিপত্য, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন বাড্ডা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক বাউল সুমন। তিনি কিছু দিন আগে স্ট্রোক করে মারা যান। এর পর থেকেই সাধারণ সম্পাদকের পদ পেতে এবং নেতৃত্ব দিয়ে সেখানকার আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা। আর তার অবস্থান নেওয়ার জন্য গামা অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। পদ, নেতৃত্ব, আধিপত্য বিস্তার কিংবা অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড হতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। তবে নিহতের লাশ দেখতে দুপুরে ঢামেক মর্গে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ বললেন ভিন্ন কথা। তিনি এটি অভ্যন্তরীণ হত্যাকাণ্ড নয় দাবি করে বলেন, জাতীয় শোক দিবসকে ভণ্ডুল করতে প্রতিপক্ষ এ গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে।
পুলিশ বলছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তিনজনকে খুন করা হয়েছে। নতুন পদ, নেতৃত্ব, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। গতকাল দুপুরে গুলশান জোনের ডিসি এস এম মোস্তাক আহমেদ খান বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। এর সঙ্গে জড়িত দু-তিন জনকে সন্দেহ করা হয়েছে। আর এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য থানায় আনা হয়েছে। তবে এটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু শুটার নয়; এর পেছনে থাকা লোকদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে এ ঘটনায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (রাত ৮টা) কোনো মামলা হয়নি।
এদিকে, ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নিহত তিনজনের ময়নাতদন্ত সম্পন্নের পর দুপুরে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুজ্জামান চৌধুরী জানান, তিনজনকেই খুব কাছ থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। মানিক ও গামার শরীরে গুলি পাওয়া গেছে আর শামসুর শরীর ভেদ করে গুলি বের হয়ে গেছে। নিহত তিনজনকেই গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো।

সর্বশেষ খবর