শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

জিয়াকে সেনাপ্রধান করলে খুন হতেন না বঙ্গবন্ধু

কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম

জিয়াকে সেনাপ্রধান করলে খুন হতেন না বঙ্গবন্ধু

সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম বলেছেন, জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলে ১৫ আগস্টের দুঃখজনক ঘটনা না-ও ঘটতে পারত। তিনি বলেন, আমি তখন সেনাবাহিনীতে কর্মরত। বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ায় দেশজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। তখন সেনা সদস্যদের চোখে অশ্রু দেখেছি। রণাঙ্গন থেকে সদ্য ফিরে আমরা সেনাবাহিনীতে। তখন সেনাবাহিনীর বৃহত্তম অংশ ছিল যুদ্ধফেরত। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে আমরা বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম। আমরা অনেকে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, এ জন্যই কি আমরা যুদ্ধ করেছিলাম? এ কী হয়ে গেল? কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। তিনি মনে করেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান না করে তখন যদি তিনি মেজর জিয়াকে সেনাপ্রধান করতেন, তবে ১৫ আগস্টের মতো দুঃখজনক ঘটনা না-ও ঘটতে পারত।   

জাফর ইমাম বলেন, ১৫ আগস্ট যারা এ দুঃখজনক ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা ছিল সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং দুটি ইউনিট। এর একটি সেকেন্ড আর্টিলারি, যা ছিল কর্নেল রশীদের অধীনে। অন্যটি আর্মড ইউনিট, ছিল কর্নেল ফারুকের অধীনে। তাদের সঙ্গে জড়িত ছিল সেনাবাহিনী থেকে সদ্য বহিষ্কৃত মেজর ডালিম, নূরসহ কিছু অফিসার; যারা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে সেনাবাহিনীতে ঢুকেছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, যারা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এ দুই ইউনিটে ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘাতকরা। তারা যখন অপারেশন চালিয়েছে তখন বাংলার মানুষ ছিল ঘুমন্ত অবস্থায়। তারা নাইট ট্রেনিংয়ের নামে রাত ১২টায় বর্তমান বিমানবন্দরের রানওয়েতে সমবেত হয়েছিল। এখানেই তারা মায়ের দুধের কসম খেয়ে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি ও অন্যদের টার্গেট নিয়ে অগ্রসর হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল রাতের মধ্যে অপারেশন শেষ করা। কিন্তু তাদের অপারেশন ১ ঘণ্টা বিলম্ব হয়। যখন এক গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে ট্যাংকবহর নিয়ে যায়, একই সময়ে অন্য গ্রুপ যায় মণি ভাইকে (শেখ ফজলুল হক মণি) টার্গেট করে। তাদের অপারেশন ১ ঘণ্টা বিলম্ব হওয়ায় সঠিক সময়ে তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে পারেনি। তিনি বলেন, ঘটনার আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহসহ অন্যদের সঙ্গে আলাপও করেছিলেন। কিন্তু জেনারেল সফিউল্লাহ সময়মতো ঢাকা সেনানিবাস তথা ৪৬ ব্রিগেডকে নির্দেশ দিতে ব্যর্থ হন। তিনি যদি সময়মতো সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিতেন এবং বঙ্গবন্ধুকে (বাড়ির দ্বিতীয় তলায়) বেরিয়ে না আসতে পরামর্শ দিতেন তাহলে এদের অপারেশন আরও বিলম্বিত হতো। কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুকে এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন কি না তা আমি জানি না। ঘটনার আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে বলেছিলেন- ‘এই! তোরা কী চাস?’ তখন ঘাতকের গুলিতে সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর হাতে ছিল পাইপ। আশপাশের এলাকার মাইকে ভেসে আসছিল সুমধুর আজানের ধ্বনি- আসসালাতু খাইরুম মিনাননাউম...। এ সময়ে অন্যদিকে ঘাতকরা মণি ভাইয়ের বাড়িতে অপারেশন চালায়। এমনকি তারা তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকেও হত্যা করে। এ সময় ঢাকার রাজপথে হাজার হাজার মানুষ মর্নিংওয়াকে নেমে পড়েছিল। ঘাতকদের অপারেশনের আগে বঙ্গবন্ধু যদি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় না আসতেন আর সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেডকে আক্রমণের নির্দেশ দিতেন তখনই তারা চলে আসত। তখন হয়তো দুঃখজনক এ ঘটনা না-ও ঘটতে পারত। ইতিহাস ভিন্ন হয়ে যেত। যদি সেনাবাহিনী অপারেশনে যেত সঙ্গে থাকত হাজার হাজার মানুষ। ঘাতকদের ঘেরাও করতে পারত। তাদের পালানোর সুযোগ ছিল না। কেননা ঘাতকদের ট্যাংকবহর ছিল শুধু শোডাউনের জন্য। এমনকি ট্যাংকে গোলাবারুদও ছিল না। এ ছাড়া কর্নেল জামিল একাই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। প্রবেশপথে তিনি ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। কিন্তু সেনাপ্রধান বঙ্গবন্ধুর জন্য কিছুই করেননি। কর্নেল জাফর বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই জেনারেল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু সফিউল্লাহ প্রটোকলে জুনিয়র ছিলেন। আর তখন জেনারেল জিয়াউর রহমানও অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দক্ষ অফিসার ছিলেন। তার রাজনৈতিক দিক নিয়ে কথা বলছি না। তবে ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু যদি সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান না করে তৎকালীন মেজর জিয়াকে সেনাপ্রধান করতেন তবে ১৫ আগস্টের মতো দুঃখজনক ঘটনা না-ও হতে পারত। কারণ, জিয়া ছিলেন উচ্চাভিলাষী অফিসার। তার মধ্যে সেনাপ্রধান না হওয়ার ক্ষোভও ছিল।   

অন্যদিকে ঘাতকদের ক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে জিয়ার পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। বিক্ষুব্ধ জিয়া সেদিন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নাটকীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেটা হয়তো তার কৌশল ছিল। তিনি হয়তো আর একটি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোশতাকের কাছ থেকে ক্ষমতা নেবেন- এটা তার উদ্দেশ্য ছিল। আর যদি জিয়া সেনাপ্রধান থাকতেন তবে এ ক্ষুদ্র অংশের ষড়যন্ত্রকে প্রাধান্য দিতেন না। এ ছাড়া রণাঙ্গনফেরত সেনাবাহিনীর সদস্যদের ৯০ ভাগ ছিল বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। ১৫ আগস্টের দুঃখজনক ঘটনায় আমি লক্ষ্য করেছি সেনা সদস্যদের চোখে পানি। অনেকের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভও দেখেছি। তিনি বলেন, যুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা তৈরি করা হয়। ওই সময় কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে মাহবুব আলম চাষী ও তৎকালীন দূতাবাসের হাইকমিশনার হোসেন আলী ও অন্যদের যোগসাজশে এ ষড়যন্ত্র করা হয়, পরে যার বাস্তবায়ন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মোশতাকরা ত্বরান্বিত করে। তিনি বলেন, স্বাধীনতা-উত্তর মুজিব বাহিনীর একটা বিরাট অংশ জাসদের নেতৃত্বে বের হয়ে গিয়ে গণবাহিনী তৈরি করে, এটা আওয়ামী লীগকে অনেকটা দুর্বল করে। এ ছাড়া তখন আওয়ামী লীগের মধ্যে সাংগঠনিক দুর্বলতাও ছিল। এ পরিস্থিতিতে মোশতাকরা বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যায়। ফলে ১৫ আগস্ট আরও ত্বরান্বিত হয়। আমি মনে করি, ঘাতকদের বিচারের পাশাপাশি যারা ওই দিন মুজিব বাহিনী থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে প্রটেকশন দিতে ব্যর্থ হয়েছে তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। জাফর ইমাম বলেন, আজ মহান নেতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তবে এটাকে দলীয়করণের গণ্ডিতে রাখলে চলবে না।

সর্বশেষ খবর