শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

জিয়া ১৫ আগস্ট, খালেদা-তারেক ২১ আগস্টে জড়িত : প্রধানমন্ত্রী

জিয়া ১৫ আগস্ট, খালেদা-তারেক ২১ আগস্টে জড়িত : প্রধানমন্ত্রী

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারে হত্যার ঘটনার সঙ্গে জিয়াউর রহমান যেমন জড়িত ছিলেন, তেমনই ২১ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে খালেদা জিয়া ও তার কুলাঙ্গার ছেলে তারেক রহমান জড়িত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই ভয়াবহ হামলার বিচার চলছে, আশা করি প্রকৃত অপরাধীরা উপযুক্ত সাজা পাবে। এটা অবশ্যই হতে হবে। নইলে দেশে সন্ত্রাস বাড়তে থাকবে। শেখ হাসিনা গতকাল বিকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এক স্মরণসভায় বক্তৃতা করছিলেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শহীদদের স্মরণে এ সভার আয়োজন করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। বক্তৃতা করার আগে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী বেদিতে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। এরপর কেন্দ্রীয় ১৪ দল এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। পরে শহীদ পরিবার ও আহতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে কাছে পেয়ে স্বজন ও আহতরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় শেখ হাসিনাকেও চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। শেখ হাসিনা তার ৩১ মিনিটের বক্তৃতার পুরোটা সময়ই ছিলেন আবেগাপ্লুত। দু-দুটি মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাকে বেশ কয়েকবার চোখ মুছতেও দেখা যায়। গ্রেনেড হামলার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তখন বিএনপি ক্ষমতায়। আলামত রক্ষা করা তো দূরের কথা, আলামত নষ্ট করে তারা। সিটি করপোরেশনের গাড়ি এনে আলামত দ্রুত নষ্ট করে।... দুটো গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়নি, সেগুলো সংরক্ষণ না করে নষ্ট করে দেয়। সেই সময় সরকারে থাকা এ দলটির নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আমি নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে নিজে নিজেকে মেরেছি। কি ন্যক্কারজনক! যারা মেরেছিল, তাদের বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো! খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র করার স্লোগান দিয়েছে, খালেদা জিয়া তাদের সমর্থন দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন আমরা সন্ত্রাসবিরোধী র‌্যালি করতে গিয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার শিকার হই। যে গ্রেনেড যুদ্ধে ব্যবহার হয়, সেই গ্রেনেড আমাদের সভায় ছুড়ে মেরে হত্যা করা হয়। ওই হামলায় যারা জড়িত ছিল তাদের দেশের বাইরে চলে যেতে সহায়তা করেছিল তখনকার সরকার। সাজায় জজ মিয়া নাটক। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি এদেশে রাজনীতি করছে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পুড়িয়ে মানুষ মেরে স্বস্তি পান। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু করে প্রায় তিন মাস ৬৫ জন নেতা-কর্মী নিয়ে গুলশান অফিসে নিজেকে নিজে বন্দী করে বসে বসে হুকুম দিয়ে বাসে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে মারলেন। কিন্তু এত মানুষ পুড়িয়ে মারার জন্য তিনি কোনো লজ্জাবোধ করলেন না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষ পুড়িয়ে মেরে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করা। তিনি বলতেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত না করেই নাকি তিনি ঘরে ফিরবেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদেশে নারী ও শিশু হত্যা শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। শুধু ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্টই নয়, ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত যেসব বোমা হামলা, হত্যা এবং ২০১৫ সালে পেট্রলবোমা হামলা হয়েছে সেগুলোর পরিকল্পনাকারীদের শাস্তি দিতেই হবে। অপরাধীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব না, দেওয়া যায় না, সে যেই হোক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে আর দেশের মানুষের শান্তি চায়। কিন্তু যখনই আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যায় তখনই বিএনপি গণতন্ত্রের নামে হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়। বিএনপি আবার গণতন্ত্রের কথা বলে। যারা গণন্ত্রের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারে তাদের মুখে গণতন্ত্র মানায় না।
বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে স্মরণসভা স্থলে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। প্রথমে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। তারপর প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, পরে দলীয় সভানেত্রী হিসেবে নেতা-কর্মীদের নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত শহীদদের স্মৃতির প্রতি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাহারা  খাতুন, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, এইচ টি ইমাম, সতীশ চন্দ্র রায়, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, মাহবুব-উল আলম হানিফ, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, ড. আবদুর রাজ্জাক, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, কর্নেল (অব.) ফারুক খান, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ডাক তার ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিম, ফরিদুন্নাহার লাইলী, এনামুল হক শামীম, মাইনুদ্দিন হাসান চৌধুরী প্রমুখ। এ ছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগের এম এ আজিজ, যুবলীগের ওমর ফারুক চৌধুরী, হারুন অর রশিদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মোল্লা মো. আবু কাওছার, পঙ্কজ দেবনাথ, কৃষক লীগের মোতাহার হোসেন মোল্লা, খন্দকার শামসুল হক রেজা, ছাত্রলীগের সাইফুর রহমান সোহাগ, জাকির হোসাইন, মহিলা লীগের আশরাফুন্নেছা মোশাররফ, যুব মহিলা লীগের নাজমা আক্তার, অপু উকিল, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন, বদিউজ্জামান সোহাগ ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের শফিকুল বাহার মজুমদার টিপু প্রমুখ।  শেখ হাসিনা বলেন, স্বজন হারানোর কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকাটা যে কী কষ্টের! আমরা দুই বোন এটা হাড়ে হাড়ে টের পাই। ঘটনার মাত্র ১৫ দিন আগে দেশ ছেড়ে স্বামীর কর্মস্থলে গিয়েছিলাম। সঙ্গে রেহানাকে নিয়ে যাই। ফিরে এসে পরিবারের কাউকে পাইনি। তিনি বলেন, আর্মি অ্যাক্ট ভঙ্গ করে জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে সেনাবাহিনীতে একের পর এক হত্যা চালান। আমরা দুই বোন বিদেশের মাটিতে কষ্টে কাটাই। জিয়াউর রহমান কোনো দিন চাননি আমি দেশে ফিরে আসি। জিয়া ক্যুর রাজনীতিতে বিশ্বাসী। ক্ষমতায় এসে তিনি ’৭১-র স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিষ্ঠিত করেন। তাদের হাতেই তুলে দেন লাল-সবুজের পতাকা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে। যদিও বেশ কয়েকজন হত্যাকারী বিদেশের মাটিতে পালিয়ে আছে। আমেরিকা, কানাডা, পাকিস্তানে পালিয়ে আছে। তারা খুনিদের ফেরত দিচ্ছে না। অথচ তাদের মুখে আমাদের  মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়। আমার প্রশ্ন, আমার পিতাকে যখন হত্যা করা হয়, নারী, শিশু, অন্তঃসত্ত্বাদের হত্যা করেছিল, তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তখন তাদের মানবাধিকারবোধ কোথায় থাকে?
স্মৃতিচারণা করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি তখন বিরোধীদলীয় নেতা। সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বিশেষ করে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা হামলার প্রতিবাদে ২১ আগস্ট শান্তির সমাবেশ করতে এসেছিলাম। বক্তৃতাও শেষ হয়েছে, এর মধ্যে ফটো সাংবাদিকরা বললেন, আপা ছবি পাইনি। এর ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে একের পর এক গ্রেনেড হামলা। আমার পাশে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ভাই মানবঢাল তৈরি করে আমাকে রক্ষা করেন। সেই হামলায় কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভী রহমান, আমাদের সবার প্রিয় আদাচাচাসহ ২২ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নিহত হন। তিনি বলেন, গ্রেনেডের স্পি­ন্টার বিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হন অনেকে। আহত হন অনেকে। আহতদের অনেকেরই স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি। তিনি বলেন, হামলায় যখন মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ পড়ে আছে, মানুষ যখন বাঁচার জন্য দিগি¦দিক ছুটে বেড়াচ্ছে তখন কাঁদুনে গ্যাস ছোড়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল খুনিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করা। এমনকি তৎকালীন সরকার প্রধান খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি আইভী রহমানকে সিএমএইচ হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন, কিন্তু আইভীর ছেলেমেয়েদের একটি ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য কী ছিল তা এখনো উদ্ঘাটন হয়নি। শেখ হাসিনা আরও বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলতেন, আমি নাকি প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, কোনো দিন বিরোধীদলীয় নেতাই হতে পারব না। তিনি কীভাবে অমন ভাগ্য গণনা করেন। সেদিন বিএনপি নেতাদের কথাবার্তাও ওরকমই ছিল। তাই মনে হয়, তারা আগে থেকেই বিষয়টি জানতেন। ফুলে ফুলে ছাওয়া অস্থায়ী শহীদ বেদি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা নিবেদন ও বক্তৃতা শেষে যখন অস্থায়ী বেদি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তখন মানুষের ঢল নামে। ওয়ার্কার্স পার্টি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, কেন্দ্রীয় যুবলীগ, যুবলীগ উত্তর ও দক্ষিণ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, তাঁতী লীগ, শহীদ মোস্তাক আহমেদ সেন্টু পরিষদ, একুশে আগস্ট বাংলাদেশ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পেশাজীবী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মৎস্যজীবী লীগ, তরুণ লীগ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিভিন্ন সংগঠন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানায়। তবে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় বিশৃঙ্খলাও ছিল চোখে পড়ার মতো। আলাদাভাবে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ, সাম্যবাদী দল, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী সমবায় লীগ, ২১ আগস্ট বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এদিকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে প্রথম দিবসের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়। নারকীয় সেই হামলা স্মরণ করে রাত ১২টা ১ মিনিটে মোমবাতি প্রজ্বালন করে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ নামের সংগঠনের  নেতা-কর্মীরা।

সর্বশেষ খবর