শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

এখনো দুঃসহ স্মৃতিতে জজ মিয়া

এখনো দুঃসহ স্মৃতিতে জজ মিয়া

‘সিআইডি অফিসের নির্যাতনের কথা কোনো দিনও ভুলতে পারুম না। মাঝেমধ্যে রাইতে ঘুমের মধ্যে ওই দৃশ্য চোখের সামনে আইয়া পড়ে। ভয়ে লগে লগে ঘুম ভাইঙ্গা যায়। আমি কিছুতেই ওই স্মৃতি ভুলতে পারতাছি না। এহনও আমার মেরুদণ্ডে মাঝেমধ্যেই ব্যথা করে। শীত আইলেই ব্যথা বাইড়া যায়। পুলিশ মারতে মারতে আমার হাতও ভাইঙ্গা ফালাইছিল। হেগো কথা না হুনলে ক্রসফায়ার দিবার চাইছিল আমারে।’ বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন চাঞ্চল্যকর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় গ্রেফতার হওয়া জজ মিয়া। দুঃসহ স্মৃতি পুনরায় আওড়াতে গিয়ে তার দুই চোখ বেয়ে অনবরত পানি ঝরছিল। জজ মিয়া এখন নারায়ণগঞ্জে মা জোবেদা খাতুন ও বোন খোরশেদাকে নিয়ে বাস করেন। পেশা- রেন্ট-এ কারের প্রাইভেট কার চালানো। নানা রকম দুঃখ-ক্ষোভে নিজেকে একরকম আড়াল করেই রেখেছেন জজ মিয়া।
তিনি বলেন, ভাই আমি আগে শাপলা চত্বরে ফল বেচতাম। ওই সময় ব্যবসার অবস্থা খারাপ হইয়্যা যাওয়ায় আমি বাড়ি চইল্যা গেছিলাম। ঘটনার দিন আমি আমাগো গেরামের বাবুলের চায়ের দোকানে বইস্যা টিভিতে ওই দৃশ্য দেখছিলাম। হের সাত-আট মাস পর সিআইডি আমারে সেনবাগ থাইক্যা ধইর‌্যা লইয়্যা আহে। এসপি (সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশীদ) রশীদ সাবরে কত কইছি স্যার আমি ওই দিন গ্রামেই আছিলাম। আপনি জিগাইয়া দেহেন গেরামের হগলরে। হে আমার কোনো কথা শুনে নাই। সিআইডি অফিসে আমারে খুব মারছে ভাই। একসময় ক্রসফায়ারের ভয় দেহাইছে। পরে হেগো কথা অনুযায়ী আমি কোর্টে গিয়া সব কইছি। এর আগে আমারে ঘটনার ভিডিও দেখাইছে বার বার। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নেওয়ার সময়ও বার বার আমারে বলা হইছে যদি উল্টাপাল্টা করছ তাইলে তোরে ক্রসফায়ারে দিয়া দিমু। জজ জানান, গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের পরিবারে নেমে আসে চরম অর্থকষ্ট। অর্ধাহার-অনাহারে দিন কেটেছে তার বৃদ্ধা মা, এক বোন ও অন্য তিন ভাইয়ের। গ্রামের বাড়িতে সাত ডেসিমেল জায়গা বিক্রি করে দেন তার মা জোবেদা খাতুন। ওই টাকা দিয়ে ঢাকায় এসে সন্তানের সঙ্গে দেখা করতেন। জমি বেচে দেওয়ায় মা জোবেদা বেগমেরও কোনো খোঁজ নেয় না জজের ভাইয়েরা। নিজের নামের ওপর যারপরনাই ক্ষুব্ধ জজ মিয়া। এ প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, ভাই আপনাগো কারণে আমি জেল থাইক্যা মুক্তি পাইছি। জন্মের পর বাপ-মায় নাম রাখছিল মো. জালাল। তয় মাইনষ্যে আমারে জজ মিয়া কইয়্যা ডাকার কারণে একসময় জালাল মিয়া তলে পইড়া গেছে। এহন অই নামটাই আমার জীবনের কাল হইয়্যা দাঁড়াইছে। ছোট বইনটারে বিয়া দিতে পারি না টাকার লাইগ্যা। নিজে বিয়ে করেছেন কি না- জিজ্ঞেস করতেই জজ মিয়া বলেন, ভাই কী আর কমু? আমার নামটাই এহন কুফা হইয়া গেছে। মাইনষ্যে কয় সরকার চেঞ্জ হইলেই নাকি আমারে আবার জেলে লইয়্যা যাইব। তাই এর লাইগ্যা কারও মাইয়্যা আমার লগে বিয়া দিবার চায় না। তয় আমার বোনটার বিয়া লইয়্যা খুব টেনশনে আছি। হের বয়স এহন ২১ হইয়্যা গেছে। আমি জেলে থাকার সময় হে একটা হাসপাতালে চাকরি করত। আমার লাইগ্যা দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়া হের চাকরিটাও চইল্যা গেছে। এত কষ্টে আছি ভাই! মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ফাঁসি হইয়া গেলেই ভালো অইত।
জজ মিয়া আরও বলেন, বিনা দোষে আমার চারটা বছর কারাগারে নষ্ট হইল। আমার জীবনের কি কোনো দাম নাই? আমি তো প্রধানমন্ত্রীর লাইগ্যাই মামলা খাইছি। প্রধানমন্ত্রী এত মানুষরে দেহে আমারে দেহে না। আপনারা উনারে জানাইয়া দেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবারও অনুরোধ করতেছি, আমার দিকে একটু তাকানোর জন্য।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি কাশিমপুর কারাগারে থাকতে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির দেওয়া আশ্বাসের প্রসঙ্গে জজ মিয়া বলেন, আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম সাব, ওবায়দুল কাদের সাব, লোটাস কামাল সাব ও সিলভার সেলিম সাব ডাইক্যা নিয়ে কথা কইছে আমার সঙ্গে। সব কিছু হুনছে। সান্ত্বনা দিছে আমারে। কইছে আমার কোনো চিন্তা করণ লাগব না। মাঝে মাঝেই হেরা আমারে ডাকত। কইছিল বাইর হইলে আমারে কিছু একটা কইর‌্যা দিব। জেল থাইক্যা বাইর হইয়া হেগো লগে দেখা করবারও গেছিলাম। দেখাই করবার পারি নাই। এহন কেউ আর আমার খোঁজ লয় না।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য কল্পিত নাটক সাজায় সিআইডি। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোর্ট গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় জজ মিয়াকে। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বানিয়ে সিআইডির ওই সময়কার তিন কর্মকর্তা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করেন জজ মিয়ার কাছ থেকে। বিনিময়ে তার মাকে প্রতি মাসে সংসার খরচের জন্য দুই হাজার টাকা করে দিতেন বলেও অভিযোগ করেন তার মা। সেই নাটকের নেপথ্য কারিগর ছিলেন সিআইডির ওই সময়কার বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিক ও আবদুর রশীদ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ফাঁস হয় আসল ঘটনা। ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জেল থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া। বিনা অপরাধে তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় চারটি বছর। পরে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে গাড়িচালকের চাকরি করলেও অধিক পরিশ্রম ও অল্প বেতনের কারণে দুই বছর আগে সেই চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।

সর্বশেষ খবর