ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজারকে খুনের পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হয়েছে। গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কের একটি ভবন থেকে জব্দ করা সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে এ দৃশ্য ধরা পড়ে। তবে ফুটেজে গুলি করা বা খুন করার কোনো দৃশ্য নেই।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুনের সঙ্গে জড়িত এ পর্যন্ত তিনজনকে শনাক্ত করা গেছে। এই তিনজনের সঙ্গে ভিডিও ফুটেজে পাওয়া মোটরসাইকেল আরোহীদের সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে। এই তিনজনের মধ্যে দুজনের নাম রাসেল এবং অপরজনের নাম রুবেল। তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা পুলিশ তা নিশ্চিত করেনি। তবে এই তিনজনের পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ পরিচয়ের কিছু লোক তাদের ধরে নিয়ে গেছে। আটকের ১২ দিনেও তারা জানতে পারছে না, তাদের সন্তানরা কোথায়। গোয়েন্দা দফতরে গিয়েও তারা তাদের সন্তানদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। একজনের পরিবার থানায় অভিযোগ করতে গেলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। অজানা আশঙ্কায় দিন কাটছে এই তিন যুবকের পরিবারের সদস্যদের। তাভেলা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খুনের পরপরই গুলশান, বাড্ডা, বনানী এবং নিকেতনসহ আশপাশের এলাকাগুলোর বিভিন্ন আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। সব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এই তিনজন ব্যক্তিকেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। হেঁটে আসা ব্যক্তির কোমরে অস্ত্রের মতো কিছু একটাও যে ছিল এ বিষয়টিও স্পষ্ট। এর বাইরে আলো-আঁধারীতে হত্যার দৃশ্য দেখা প্রত্যক্ষদর্শীরাও নিশ্চিত করেছিলেন ঘাতকরা কেউ হেলমেট পরিহিত ছিল না। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানারাত স্কুলের সামনের সিসিটিভি ফুটেজে থাকা তিন যুবকের পরিচয়ও নিশ্চিত হয়েছে। তাদের মধ্যে হেঁটে আসা যুবকের নাম রাসেল চৌধুরী এবং মোটরসাইকেল চালকের নামও মো. রাসেল। অপরজন হলেন রুবেল। এদিকে গতকাল রাসেলদের ব-৮৯ দক্ষিণ বাড্ডার বাসায় গেলে তার মা আফরোজা বলেন, ১০ অক্টোবর সকালে ডিবি পুলিশ তার বাসায় তল্লাশি চালায় এবং রাসেলকে আটক করে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা এডিসি মাহফুজুল ইসলাম বলেন, আটকের বিষয়টি তিনি জানেন না। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাসেলের মা আফরোজা বলেন, ১০ অক্টোবর বেলা ১১টার দিকে একজন লোক এসে সাদা পোশাকে তাদের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়ান। পাশের ফটক দিয়ে আরও তিন-চারজন তার বাসায় ঢোকেন। তারা রাসেলকে ভিতরের কক্ষ থেকে ধরে সামনের কক্ষে নিয়ে আসেন। এ সময় তারা রাসেলের কাছে জানতে চান, ‘তোর পরনের জিন্সের প্যান্ট স্ট্রাইপ গেঞ্জি ও কালো শার্ট কই।’ আফরোজা বলেন, ওই ব্যক্তিরা রাসেল কী করে জানতে চাইলে তিনি তাদের বলেন, ও আগে বিদ্যুৎ বিভাগে ঠিকাদারি করত। বর্তমানে বেকার। পরে পুলিশ আলমারি খুলে তল্লাশি চালায়, কিন্তু কিছু পায়নি। একপর্যায়ে তারা রাসেলের দুই হাতে কড়া লাগিয়ে দেন। ডিবির একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘তুই কোন দল করিস, ছাত্রদল না যুবদল?’ রাসেলের বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কিনা তা-ও জানতে চাওয়া হয়। পরে সাদা কাগজে কিছু একটা লিখলেও তা কাউকে পড়তে দেওয়া হয়নি। ওই কাগজে রাসেলের বাবার স্বাক্ষর ও তার মোবাইল ফোন নম্বর নেন। আমার সন্তান জীবিত না মৃত তাও আমি জানতে পারছি না। ফোন করলে পুলিশ কর্মকর্তারা বকাঝকা করছেন, জানালেন রাসেলের বাবা শাহজাহান চৌধুরী। এদিকে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যাকাণ্ডের ১৮ দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত হত্যার প্রকৃত রহস্য উম্মোচন হয়েছে কিনা, হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীকে শনাক্ত করা গেছে কিনা সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছুই বলছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় বিএনপি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা জড়িত আছেন কিনা সে বিষয়েও ইঙ্গিত মিলছে না পুলিশের তদন্ত কার্যক্রমে। তবে বিএনপির এক নেতাকে হত্যা মামলার আসামি দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় তার রিমান্ড বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়। আরেক নেতাকে আটকের পর কোতোয়ালি থানার একটি মাদকদ্রব্যের মামলায় আসামি দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আমাদের রংপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কোনিও হত্যাকাণ্ড তদন্তে পুলিশ সদর দফতরের গঠন করা পাঁচ সদস্যের কমিটির প্রধান পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবীর বলেন, এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। তদন্ত পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি হুমায়ুন কবীর হীরাকে তিন দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তার দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে অনেককেই এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদের পর বেশ কয়েকজনকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচ্য বিষয় নয়। মূল লক্ষ্য হত্যার রহস্য উন্মোচন ও খুনিদের শনাক্ত করা। আমরা সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছি। তবে হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে যতদূর যাওয়া দরকার ততদূরেই যাব আমরা। এদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মামুনুর রশীদ মামুন বলেন, কোনিও খুনের ঘটনায় তিন খুনিকে শনাক্ত করা হয়েছে। এখন হত্যার প্রকৃত রহস্য ও মূল পরিকল্পনাকারীর সন্ধান করা হচ্ছে। তবে শনাক্ত হওয়া খুনিদের গ্রেফতার করা হয়েছে, নাকি আটকদের মধ্যে তারা রয়েছে সে বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি তদন্ত কর্মকর্তা। গত ৩ অক্টোবর দুর্বৃত্তের গুলিতে হোশি কোনিও নিহত হওয়ার পরপরই রংপুর মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আনিছুর রহমান লাকু ও সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লব এবং হোশির ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন কবীর হীরাকে আটক করা হয়। ৫ অক্টোবর হীরা ও বিপ্লবকে হোশি হত্যা মামলায় আসামি দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। তবে পাঁচ দিন পরই বিপ্লবের রিমান্ড বাতিল করেন আদালত। অন্যদিকে দুই দফায় ১৫ দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর সোমবার কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলায় হীরাকে ফের ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া হীরার স্ত্রী সুলতানা বেগম রুমি ও ছোট ভাই রংপুর জেলা জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক কামাল হোসেনকে নিয়ে এসে ছয় দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এ ছাড়া এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও যাদের আনা হয়েছে তাদের মধ্যে বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী নেই। তবে জাকারিয়া বালা, রিকশাচালক মোন্নাফ আলী ও আলুটারি গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রশীদকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।