মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

‘বড় ভাই’র নির্দেশে সিজার খুন

হত্যারহস্য উদঘাটনের দাবি পুলিশের, তিনজন রিমান্ডে

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘বড় ভাই’র নির্দেশে সিজার খুন

তাভেলার খুনি সন্দেহে আটক রাসেল, মিনহাজুল, রুবেল ও শরীফ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেলা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, সরকারকে চাপে ফেলতে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চারজনকে গ্রেফতার এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলেন রাসেল চৌধুরী ওরফে চাকতি রাসেল, মিনহাজুল আরেফিন রাসেল ওরফে ভাগ্নে রাসেল ওরফে কালা রাসেল, তামজিদ আহম্মেদ রুবেল এবং সাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ। পুলিশের দাবি, এদের মধ্যে তিনজন সরাসরি খুনের সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে, গতকালই গ্রেফতার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তবে শুটার রুবেল তার নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কথিত এক বড় ভাইয়ের নির্দেশে ‘নির্দিষ্ট টাকার চুক্তিতে’ দুই রাসেল ও রুবেল এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। আর এ কাজে তারা শরীফের মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে বিদেশিরা নিরাপদ নয় এ ইস্যুতে সরকারকে চাপে ফেলতে একজন বিদেশি নাগরিককে হত্যার পরিকল্পনা ছিল। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও উদ্ধার করা হয়েছে।

পুলিশ কমিশনারের ভাষ্য, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে তিন কিলার এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, যার অর্ধেক টাকা হত্যার আগেই নিয়েছেন তারা। বাকি টাকা হত্যাকাণ্ডের পরে নেওয়ার কথা ছিল।

কথিত বড় ভাইয়ের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে কমিশনার বলেন, বছরের শুরুতে যারা ‘মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে’, তারা এ ঘটনায় যুক্ত কিনা, তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে ওই সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) শেখ মুহাম্মদ মারুফ হাসান, ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনের আগে গ্রেফতার চার যুবককে মিডিয়া সেন্টারে আনা হয়। তাদের ভিডিওচিত্র ধারণ করতে দেওয়া হলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।

কমিশনার বলেন, রাসেল চৌধুরী ওরফে চাকতি রাসেলকে গুলশান থেকে গ্রেফতার করা হয়। মিনহাজুল আবেদীন রাসেল ওরফে ভাইগ্না রাসেল ওরফে কালা রাসেলকে বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকা থেকে, তামজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে মোবাইল রুবেল ওরফে শুটার রুবেলকে বাড্ডার একটি গোপন আস্তানা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ভাইগ্না রাসেলের স্বীকারোক্তি ও দেখানো মতো ঘটনায় ব্যবহৃত এফজেডএস মোটরসাইকেলটি মধ্য বাড্ডার ট-১১৯ নম্বর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। মোটরসাইকেলের মালিক সাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে আদায় তথ্যের বরাত দিয়ে কমিশনার বলেন, ঘটনার দিন চাকতি রাসেল ৯০ নম্বর রোডের পুব দিকে সিটি করপোরেশন অফিসের সামনে অপেক্ষা করেন তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী একজন বিদেশিকে হত্যা করার জন্য। পরে ভাইগ্না রাসেল ও শুটার রুবেল একই জায়গা দিয়ে মোটরসাইকেলে গিয়ে আগে অপেক্ষমাণ রাসেলের সঙ্গে একত্রিত হন। যখন তাভেলা সিজার ৯০ নম্বর রোডের পুব থেকে পশ্চিম দিকে আসেন তারা দেখেন একজন বিদেশি আসছেন। তখন রাসেল চৌধুরী ওরফে চাকতি রাসেল ও শুটার রুবেলকে দেখিয়ে দেন। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে ওই বিদেশিকে ফলো করেন। তারা ৯০ নম্বর সড়কের মাথায় গিয়ে ইউটার্ন নিয়ে ব্যাক করে আসেন। এর মধ্যে যখনই তাভেলা সিজার সড়কের পশ্চিম মাথার দিকে চলে যান তখন তামজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল তাভেলা সিজারকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। গুলি করার পরপরই তাভেলা যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, তখনই রুবেল দৌড়ে ৮৩ নম্বর রোডের সংযোগস্থলে গিয়ে মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যান।

তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার শরীফ দাবি করেছেন কানা রাসেল তাকে অনুরোধ করেছিলেন যে আমাদের একটা অপারেশন আছে আপনার মোটরসাইকেলটি আমাদের দিতে হবে। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে মোটরসাইকেলটি তিনি দেন। সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে ভাইগ্না রাসেল রাতে তা ফেরত দেন। আমরা ব্যাপকভাবে ঘটনার তদন্ত করি। আমরা প্রযুক্তির সাহায্য নিই, সিসিটিভি ফুটেজের সাহায্য নিই, এরপর আমরা যখন খুনিদের নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করি তখনই অভিযান পরিচালনা করি।

ব্যবহৃত অস্ত্র এবং কিলারদের কী পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, হত্যাকাণ্ডে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে এ তিনজন দুই রাসেল ও রুবেল, ভাড়াটিয়া খুনি হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি অনুযায়ী পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে খুনের এ কাজটি করেন তারা। অর্ধেক টাকা ঘটনার আগেই দেওয়া হয়েছে, বাকি অর্ধেক ঘটনার পর দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা এখনো পাননি। তবে আমরা সেই কথিত বড় ভাইকে খুঁজছি। তার অস্তিত্বকে আমরা শনাক্ত এবং গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। পাশাপাশি এ ঘটনার কী মোটিভ এবং বড় ভাইয়ের পেছনে আরও মদদদাতা কারা, বেনিফিশয়ারি কারা সে বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে তদন্ত করছি। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি উদ্ধারের জন্য আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। অস্ত্রটি উদ্ধার এবং ব্যালাস্টিক পরীক্ষার পর তা আদালতে উপস্থাপন করব।

কমিশনারের ভাষ্য, গ্রেফতার দুই রাসেলই মাদকাসক্ত। তারা বিভিন্ন সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন এবং কারাভোগ করেছেন। তামজিদ আহম্মেদ রুবেল একজন দুর্ধর্ষ এবং ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে পরিচিত। তার ক্রিমিনাল রেকর্ড আমাদের হাতে রয়েছে। আর মোটরসাইকেলের মালিক সাখাওয়াত হোসেন এলাকায় ইয়াবা ব্যবসায়ী ও অস্ত্র সরবরাহে যুক্ত বলে আমরা তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি।

তিনজন রিমান্ডে, একজনের স্বীকারোক্তি : গ্রেফতার রুবেল হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান আসামি রুবেলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। অন্যদিকে, গ্রেফতার চাকতি রাসেল, ভাইগ্না রাসেল ওরফে কালা রাসেল এবং সাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফকে আট দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম মাহবুবুর রহমান এ আদেশ দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেহাদ হোসেন আসামিদের আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। প্রসঙ্গত, ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানের সড়কে তাভেলাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যান মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা। আইসিসিও কো-অপারেশন নামে একটি সংস্থার প্রুফ (প্রফিটেবল অপরচ্যুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন ইতালির এই নাগরিক, ঢাকায় তিনি একাই থাকতেন। ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটকের খবর এর আগে গণমাধ্যমে এলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কখনো বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর