মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা
তাজিয়া মিছিল প্রস্তুতিতে হামলা

জীবন নিল গ্রেনেড শরীর নিল পুলিশ

মাহবুব মমতাজী

জীবন নিল গ্রেনেড শরীর নিল পুলিশ

সাজ্জাদ হাসান সানজু

আদরের সানজুকে হারিয়ে নিস্তব্ধ-নির্বাক তার পরিবার। গ্রেনেড কেড়ে নিয়েছে সাজ্জাদ হাসান সানজুর (১৫) তরতাজা জীবন। পুলিশ নিয়েছে তার শরীরের অঙ্গগুলি। আমরা জীবন্ত সানজুকে ফিরে না পেলেও তার সম্পূর্ণ শরীরটাও পাইনি। অন্তত তার দেহ ঠিকমতো দাফন করতে পারলে মনকে কিছুটা সান্ত্বনা দিতে পারতাম। এসব অভিযোগ, শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে গ্রেনেড হামলায় নিহত সুন্নি কিশোর সানজুর পরিবারের। সানজুর স্বপ্ন ছিল সাকিব আল হাসানের মতো বড় ক্রিকেটার হওয়ার। বাবা-ভাইদেরও সায় ছিল তাতে। ভালো খেলতে পারায় বন্ধুরাও উৎসাহ দিত তাকে। আর মায়ের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার বানানোর। সব স্বপ্ন ভেঙে বাবা-মা ও স্বজনের মায়া-মমতা ত্যাগ করে শুক্রবার রাত আড়াইটায় চিরকালের জন্য পাড়ি জমিয়েছে পরপারে। সানজু দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চড়াইল উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। বাবা-মায়ের সাত ছেলে-মেয়ের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। ছিল আদরের মধ্যমণি। ‘সানজুর বন্ধু, শিক্ষক ও প্রতিবেশী সবাই বাড়িতে এসে সমবেদনা জানাইতাছে। কিন্তু কেউ আমার সানজুকে ফিরায় দিতাছে না।’ আকুতির সুরে মা রাশিদা বেগম ছেলের কথা বলছেন আর সজল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকছেন। ‘আমার কলিজাকে কাইড়া নিল বোমে। আর ছেলের কলিজাটা কাইটা নিল তারা। ঘটনার দিন বিকাল থেকে সে হোসনি দালানে যাইব বার বার কইতেছিল। রাত ১০টার দিকে ওর ভাই-ভাবীর লগে গেল। হঠাৎ রাত ৩টায় ফোন আইল আর আমার কলিজাটা ডাক দিয়া উঠল। পরক্ষণেই শুনি সানজু নাই। ওরে নিয়া আমাগো কত স্বপ্ন ছিল।’ তার পরিবার বলছে, হোসনি দালানের ভিতর এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। যারা সব ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, যারা মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী নয় তারাই এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। সানজুর বাবা মো. নাসির উদ্দিন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। তিনি কেরানীগঞ্জের শুভাড্যা ইউনিয়নের উত্তরপাড়া হাবিবনগরে স্ত্রী, পাঁচ ছেলেকে নিয়ে থাকতেন। গতকাল বাসার দোতলা ফ্ল্যাটে চৌকাঠ পেরোতেই দেখা গেল সুনসান নিস্তব্ধতা। বাবা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বেঞ্চের ওপর নির্বাক বসে আছেন। আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান বাবা বললেন, ‘সানজু ক্রিকেট খেলার জন্য পাগল ছিল। ওকে অনেক মারধর করতাম। সে বলত ক্রিকেটার হবে। আমি বলতাম ভালো করে লেখাপড়া কর। কয়েক দিন পর ক্লাবে ভর্তি করায় দিব। আর ছেলের ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারলাম না।’ এক সপ্তাহ আগের তোলা সানজুর একটি ছবি দেখিয়ে বাবা বলেন, ‘ছোটকালে আমার সঙ্গে তাজিয়া মিছিলে যেত সে। গতবার থেকে নিজে নিজে যাওয়া শুরু করে। আমার ছেলে জীবন হারিয়েছে বোমের আঘাতে। আর শরীরটা হারিয়েছে পুলিশের কারণে। ছেলের লাশ পেতে পুলিশ হাসপাতালের মর্গ নানাভাবে হয়রানি করেছে। সবাই জানে বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ গেছে ছেলের। সানজুর লাশ দিতে পুলিশের পক্ষ থেকে এক ঘণ্টার আশ্বাস দেওয়া হলেও তা গড়ায় পরদিন পর্যন্ত। বার বার পোস্টমর্টেম না করার মিনতি করলেও তারা তা করে। দাফনের সময় দেখি ছেলের খোলস ছাড়া কিছু নেই। এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো লোক সমবেদনা জানাতে আসেনি। কী দোষ ছিল আমাদের।’ তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে সানজুর সঙ্গে আরও আহত হন সানজুর ভাবী সুমি আক্তার, ভাতিজি ও ভাইয়ের শাশুড়ি। ভাবী বাড়ি ফিরলেও ভাতিজি এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪ নম্বর বেডে ভর্তি আছেন। ভাইয়ের শাশুড়ি ভর্তি আছেন ১১ নম্বর বেডে। প্রত্যক্ষদর্শী সানজুর ভাবী বলেন, ‘আমি সানজু, আমার ছোট মেয়ে ও ওর ভাই একসঙ্গে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরপর শব্দ হয়। সবাই বলে আতশবাজি ফুটতাছে। রাত আড়াইটার সময় বিকট শব্দে কী যেন ফুটল। সবাই হুমড়ি খাইয়া পালাইতাছিল। সানজু পইড়া যায়। ওর ওপর অনেকে পড়ে। উঠায়া দেখি জ্ঞান নাই। তাড়াতাড়ি দালানে নিলাম। ওর পিঠে বোমা লাগছে তখনো দেখি নাই। ওর শরীরে পানি ঢালতেই রক্তের বন্যা বইতেছিল। ওইখানে ডিবি পুলিশের গাড়ি ছিল। কইলাম পোলাডারে হাসপাতালে নিতে সাহায্য করেন। তারা একটা অ্যাম্বুলেন্স দেখায়। এক লোক রিকশায় ঢাকা মেডিকেলে নিতে সাহায্য করে। আমি ডাক্তারের কই পিঠ দিয়া রক্ত পড়তাছে ব্যান্ডেজ দেন। এক নার্স দেখায় এক ডাক্তারকে। ওই ডাক্তার দেখায় আরেক ডাক্তারকে। পরে একটা স্যালাইন লাগাইল। কিন্তু সানজুর জ্ঞান ফিরল না।’ সানজুর ভাই রফিকুল হাসান সাজু বলেন, ‘আমরা সুন্নি। আশুরায় রোজা রাখি, মিষ্টি বিতরণ করি, খিচুড়ি করে খাওয়াই। হোসনি দালানে দোয়া করতে যাই। সেদিন পুলিশ আমাদের হয়রানি করে। যখন নিশ্চিত হলাম ভাই বেঁচে নেই এক পুলিশ কমিশনারকে বললাম লাশটা তাড়াতাড়ি দেন। তিনি আরেক পুলিশকে ডেকে বলে সহযোগিতা কর। ওই পুলিশ বলল লাশ দিব না, দিলে মিছিল হবে। এক ঘণ্টা পরে নিয়েন। এক ঘণ্টা পরদিন গড়ায়। আমরা না করার পরও পোস্টমর্টেম করা হয়।’ পরিবারের সদস্যরা জানান, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সানজুর বাবাকে ফোন করে বলা হয় জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসকের অফিসে যেতে। বলে তাড়াতাড়ি আসেন নইলে কিন্তু পাইবেন না। তার বাবা ‘কী পামু না’ জিজ্ঞাসা করলে ওরা বলে মুরুব্বি একটু আসেন কথা বলি। এ বিষয়টিকে শোকার্ত একটি পরিবারের জন্য চরম এক হয়রানি বলেও অভিযোগ করেন তারা।

 

সর্বশেষ খবর