বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ট রে ন্টো র চি ঠি

ডিজিটাল সরকারের অ্যানালগ মন্ত্রী!

শওগাত আলী সাগর

পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রির পরিকল্পনার তথ্যটাই জেনে গিয়েছিল ভারত সরকার। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশটির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র লেনদেনের সম্পর্ক গড়ে উঠুক, তা কোনোভাবেই চাচ্ছিল না ভারত। মার্কিন প্রশাসনে এ নিয়ে দেনদরবারের জন্য লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে ভারত। ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতার বাইরেও বেসরকারি এ ফার্মটি জোর তৎপরতা চালায়। কিন্তু মার্কিন সরকার সবকিছু উপেক্ষা করে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলে। ক্ষোভ প্রশমন করতে না পেরে ভারত সরকার প্রথমেই লবিস্ট ফার্মটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দেয়। সেটা ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের কথা। মার্কিন সরকারের কাছ থেকে স্বার্থ আদায়ে ব্যর্থ হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ওই সময়ের সর্ববৃহৎ লবিস্ট ফার্ম ‘একনি গাম্প’ বাংলাদেশের রাজনীতিতেও আলোচনায় উঠে এসেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে ইস্যু হতে যাওয়া প্রথম আন্তর্জাতিক বন্ডের পরামর্শক হিসেবে ‘একিন গাম্প’ তেমন একটা আলোচনায় আসতে পারেনি। অথচ সিঙ্গাপুর স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত বাংলালিংকের ৩০০ মিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক বন্ডের পরামর্শক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি কম সাফল্য দেখায়নি। তবু ‘একিন গাম্প’ আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে, বিএনপির আন্তর্জাতিক লবিস্ট হিসেবে। “লবিস্ট নিয়োগের ‘প্রমাণ’ দিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী”- এ শিরোনামেই খবরটা বেরিয়েছে ঢাকার মিডিয়ায়। বিএনপি যে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে তার প্রমাণসমেত তথ্য তুলে ধরেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। প্রতিমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের এ খবরটা যুগপৎ আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়েই পড়তে হলো। বিদেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের লবিস্ট নিয়োগের তথ্যটি নতুন নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে এ জোট আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেনদরবার করে বেড়াচ্ছে- এ কথা সবাই জানেন। তথাপি সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যখন সংবাদ সম্মেলনে ‘প্রমাণ’ নিয়ে হাজির হন এবং কথা বলেন, তখন সেটি আলাদা গুরুত্ব পায়। কিন্তু কয়েকটি মিডিয়ায় সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য পড়েও নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। বরং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের দায়দায়িত্ব ও ভূমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন জাগল। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম সংবাদ সম্মেলনে যে তথ্য দিয়েছেন তার সারমর্ম হচ্ছে- ১. বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের একিন গাম্প নামের একটি লবিস্ট ফার্মকে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার দিয়েছিল বলে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। ২. ২০১৫ সালের শুরুতে দলটি বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে তৎপরতা চালাতে তাদের নিয়োগ করে। এ বিষয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে উল্লেখ করে শাহরিয়ার আলম বলেছেন, লবিংয়ের জন্য মাসে ৪০ হাজার ডলার খরচ করছে দলটি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে আমি আরেকটা তথ্য খুঁজছিলাম। তা হচ্ছে, এ তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে? কিন্তু মন্ত্রীর বক্তব্যে সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। তিনি (প্রতিমন্ত্রী) বলেছেন, তারা (বিএনপি) মার্কিন ফার্মকে মাসে ৪০ থেকে ৮০ হাজার ডলার দিচ্ছে। বিষয়টি নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য অনুসারে, সরকার এ ব্যাপারে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়টি জানানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তবে এখনো জানানো হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ লবিস্ট ফার্ম ‘একিন গাম্প’-কে ওয়াশিংটনে বিএনপির হয়ে লবিং করার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের শুরুতেই। মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের তথ্য অনুসারে ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ‘একিন গাম্প’ বিএনপির হয়ে ওয়াশিংটনে লবিস্ট হিসেবে নিবন্ধনের আবেদনপত্র জমা দেয়। আইনজীবী ব্যারিস্টার টবি ক্যাডম্যান কোম্পানিটির হয়ে বিএনপির জন্য কাজ করবেন উল্লেখ করে বিএনপির সঙ্গে তাদের কাজের পরিধি সম্পর্কিত চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ জমা দেওয়া হয়। আট পাতার সে দলিলটি এই লেখকের কাছেও আছে। যতদূর জানি, এটি রাষ্ট্রীয় গোপনীয় কোনো দলিল নয়, বরং পাবলিক নথি। সে নথি প্রায় আট মাস পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে দেখাচ্ছেন এবং ‘প্রমাণ আছে’ বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। ডিজিটাল সরকারের এমন অ্যানালগ মন্ত্রী হলে চলে কীভাবে? একিন গাম্প কোনো ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান নয়। রাজস্ব ও লবিস্টের সংখ্যার হিসাবে এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালে আমেরিকার সর্ববৃহৎ লবিস্ট ফার্ম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। অর্থাৎ বিএনপি যখন তাদের নিয়োগ দেয় তখন তারা আমেরিকার মতো একটি দেশের সবচেয়ে বড় লবিস্ট ফার্মটিকেই বেছে নিয়েছিল। এত বড় একটি ফার্মের নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক ব্যাপারটাও বড়। মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে জমা দেওয়া একিন গাম্পের বিবরণী থেকেই উদ্ধৃতি দিই। ফার্মটি বলছে, বিএনপির হয়ে তারা যে ধরনের কাজের চুক্তি করেছে, তাতে তারা মাসে ৪০ থেকে ১০০ হাজার মার্কিন ডলার করে ফি নেয়। বিএনপির সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে মাসে ৪০ হাজার ডলার করে। তবে তিন মাসের কাজের পর তা পর্যালোচনা হবে। যদি কাজের চাপ বেশি হয় তাহলে প্রতি মাসে ৮০ হাজার ডলার করে দিতে হবে। প্রথম তিন মাসের ১ লাখ ২০ হাজার ডলার অগ্রিম দিয়ে দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু বিএনপির হয়ে কাজ শুরু করেছে, বিএনপিকে এই ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার দিতে হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে বিএনপির চুক্তি এবং লেনদেন সম্পর্কে কি বাংলাদেশ সরকারের কাছে আগে কোনো তথ্য ছিল না? ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস তাহলে কী করেছে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই বা কী করেছে? সুনির্দিষ্টভাবে যদি বলি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কী করেছেন? বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের আট মাস পর তিনি সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন, তার কাছে তথ্য আছে, প্রমাণ আছে, নির্বাচন কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হবে। সংবাদ সম্মেলনে আসার আগে তিনি তাদের জানিয়ে এলেন না কেন? কোনটা জরুরি ছিল- সংবাদ সম্মেলনে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা, নাকি কর্মটি সম্পাদন করা? আমেরিকার আইনে ‘লবিং’ একটি গ্রহণযোগ্য পেশা। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নানা প্রতিষ্ঠান, প্রভাবশালী ব্যক্তি বিভিন্ন গ্রুপের হয়ে লবিস্ট হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধিমালা আছে কিনা, তা জানা নেই। কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে কোথাও ষড়যন্ত্র হলে, দেশবিরোধী তৎপরতা হলে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা যদি ঘটনার আট মাস পরে সাংবাদিকদের বাণী দেওয়ার মধ্যেই নিজেদের কর্তব্যকে সীমিত করে ফেলেন, তাহলে দুশ্চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে। লেখক : টরন্টোর বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’-এর প্রধান সম্পাদক

সর্বশেষ খবর