সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কেন এই হত্যাকাণ্ড

জিন্নাতুন নূর

কেন এই হত্যাকাণ্ড

দীপনের মরদেহ ছুঁয়ে গতকাল বাকরুদ্ধ স্ত্রী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মুক্তচিন্তার চর্চাকারী ব্যক্তিদের ওপর একের পর এক হামলা হচ্ছে। যুক্তিবাদী চিন্তার পথ রুদ্ধ করতে এবং মুক্তবুদ্ধিকে ধ্বংস করতে চলছে এ সহিংসতা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নেতিবাচক অবস্থান তৈরি করাও এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অন্যতম উদ্দেশ্য। এ পর্যন্ত যতজন ব্লগার ও মুক্তচিন্তাধারী মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার একটিরও বিচার হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি উগ্রবাদীদের নতুন করে এই হত্যাকাণ্ডে আরও উৎসাহিত করছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে সরকারি মহল থেকে এই হত্যাকারীদের কোনো না কোনোভাবে অভয় দেওয়া হচ্ছে। এমনটাই মনে করছেন দেশের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতারা। এই বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, মুক্তমনা চিন্তাধারীদের দমিয়ে রেখে নীরব ভীতি তৈরির জন্যই এই নৃশংস হামলা চালানো হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে এই সৃজনশীলদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ’৭১-এ যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল একইভাবে এবার ব্লগারদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে তখন অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এই ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে বিভাজন রয়েছে। এ বিষয়গুলো সবাইকে ‘অ্যাড্রেস’ করতে হবে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের যত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার একটিরও বিচার হয়নি। যাদের প্রাণনাশের হুমকি ছিল তারা থানায় জিডিও করেছিলেন। সে হিসেবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশের নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, যারা ব্লগার ও মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর হামলা করছেন তারা কোনো না কোনোভাবে সরকারি মহল থেকে নিরাপত্তা পাচ্ছেন। সরকারের তরফ থেকে তাদের অভয় দেওয়া হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত সরকার নিজেও তাদের তথ্য আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছে। তবে যারা এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে তাদের মৌলবাদী হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এ পর্যন্ত যত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার সবগুলো ক্ষেত্রেই সরকার আগে থেকেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছে। আমার প্রশ্ন, সরকার যদি জানে কারা ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তবে একই ঘটনা বারবার ঘটবে কেন? সরকার কেনই বা তাদের ধরছে না? আমার মতে, জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, যারা এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে সরকার তাদের নিরাপত্তা দেওয়া বন্ধ করুক তাহলেই এই নৃশংস ঘটনার অবসান ঘটবে। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, বিষয়টি শুধু ব্লগার হত্যার সঙ্গেই জড়িত নয়, যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চার সঙ্গে জড়িত অর্থাৎ যারা মৌলবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন তাদের ওপরও হামলা চালানো হচ্ছে। যারা এই কাজ করছে তারা যুক্তিবাদী চিন্তার পথ রুদ্ধ করে দিতেই এমনটি করেছে। আর এমনটি হচ্ছে ধর্মীয়, জাতিগত ও বর্ণবাদী চিন্তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক চর্চার বিরোধ সৃষ্টির জন্য। আমি মনে করি, দেশের মানুষের বঞ্চনা, মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন না হওয়া ও শোষণের কথা ধামাচাপা দিতেই মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর আঘাত করা হচ্ছে। জনগণের ঐক্য নষ্ট করতে এখন ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগকে পুঁজি করে একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। আমার মতে, শোষণ-নিপীড়ন ও জনগণের বিরুদ্ধে এই হামলা।

মানবাধিকার কর্মী ও ‘নিজেরা করি’ সংগঠনের সমন্বয়কারী খুশি কবীর বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে দেশে জঙ্গিবাদ তৈরির জন্য এবং মুক্তমনা চিন্তাধারীদের দমিয়ে রেখে নীরব ভীতি তৈরির জন্য এভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে।

সাবেক তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, আমাদের সংবিধানে ৩৯(১)-এ মুক্তচিন্তার বিকাশ করার বিষয়ে উল্লেখ আছে। আর যারা মুক্তচিন্তার চর্চা করেন অর্থাৎ শিক্ষক, প্রকাশক, কবি, লেখক ও সাংবাদিক- তারা তাদের সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু উগ্রবাদীদের হুমকির কারণে এই মুক্তচিন্তার চর্চাকারীরা এখন নিজেদের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারবেন না। অবস্থা ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এ ঘটনাগুলো কারা ঘটাচ্ছে জানি না। তবে সরকার এক্ষেত্রে এই সৃজনশীল মানুষদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে সামাজিক গণমাধ্যমে নোটিস দিয়ে মুক্তচিন্তার ধারকদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এরপর তাদের ওপর নৃশংস হামলা চালানো হচ্ছে। গত শনিবার একই সময়ে দুটি জায়গায় হামলা চালানো হয়েছে। পুলিশ সব সময় জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারবে না বুঝলাম, কিন্তু যাদের আগে থেকেই প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল তাদের কেন নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, স্বাভাবিকভাবে দেখলে জঙ্গিরা প্রকাশ্যে তৎপরতায় লিপ্ত হতে পারছে না। শিবির ও জামায়াত আগেও জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত ছিল। এবার তারা মুক্তচর্চার সঙ্গে জড়িতদের নিবৃত্ত করতে এবং তারা যাতে ভয়ে মুক্তচর্চা থেকে বিরত থাকে তার জন্য একের পর এক হামলা চালাচ্ছে। হত্যাকাণ্ডগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে দলটি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে তাদের একজন আরেকজন সম্পর্কে কিছু জানে না। হত্যাকারীরা অত্যন্ত সংগঠিত এবং প্রশিক্ষিত। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে যারা তরুণ প্রজন্মকে মুক্তচিন্তা সম্পর্কে জানাচ্ছেন তাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। আইনজীবী ও মানবাধিকা কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, এ হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত হলে আমরা বহু প্রশ্নের উত্তর পেতাম। কিন্তু তা হচ্ছে না। সংবিধানে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু এ জন্য কাউকে হত্যা করা হবে এটি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সরকারকে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমনি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বও সরকারের। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দেশে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছে তখনই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থিরা যুদ্ধে নেমেছে। পরিষ্কারভাবে মুক্তবুদ্ধিকে ধ্বংস করার জন্যই এভাবে একের পর এক হামলা চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নেতিবাচক অবস্থান তৈরি করা এবং নতুন করে সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য এ হামলা চালানো হচ্ছে। এখানে সরকারের ব্যর্থতা এই যে, যারা হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর