বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চেকপোস্টে ফের পুলিশ খুন

সাখাওয়াত কাওসার, আশুলিয়া থেকে ফিরে

চেকপোস্টে ফের পুলিশ খুন

আশুলিয়ায় চেকপোস্টে খুন হওয়া পুলিশ কনস্টেবল মুকুল (বাঁয়ে)। বগুড়ায় গ্রামে গতকাল স্বজনদের আহাজারি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এবার ঢাকার আশুলিয়ায় বাড়ইপাড়া চেকপোস্টে কুপিয়ে এবং গুলি করে এক পুলিশ সদস্যকে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তদের আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন কনস্টেবল নূরে আলমসহ আরও দুজন। গতকাল সকাল পৌনে ৮টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নন্দন পার্কের উল্টো দিকে চেকপোস্টে এ ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত কনস্টেবল নূরে আলম সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। খবর শুনেই আহত ও নিহতকে দেখতে এনাম হাসপাতালে ছুটে যান স্বরাষ্টমন্ত্র্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক, বিশেষ শাখার প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পার্শ্ববর্তী হোটেল মালিক সাইদুল, শামসু, নাসির ও পরিবহন শ্রমিক কনক দাসকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এ ঘটনার ঠিক ১৩ দিন আগে ২১ অক্টোবর রাতে রাজধানীর গাবতলীর চেকপোস্টে দুর্বৃত্তদের হামলায় পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক ইব্রাহীম মোল্লা নির্মমভাবে খুন হন। গতকাল বেলা ১১টার দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নন্দন পার্ক। এর ঠিক বিপরীত পাশেই পুলিশ চেকপোস্টের অবস্থান। পাশেই রয়েছে ছয়টি খাবারের হোটেল ও চায়ের স্টল। এর মধ্যে সাইদুল মিয়ার হোটেল ও শুভেচ্ছা হোটেলে ছোপ ছোপ রক্তের ছাপ। জমাটবাঁধা রক্তে এরই মধ্যে বসতে শুরু করেছে মাছি। দুটি হোটেলই ঘিরে রেখেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা। আলামত সংগ্রহে ব্যস্ত তারা। আশপাশ ঘিরে রেখেছেন অসংখ্য উৎসুক মানুষ। সবার চোখেই আতঙ্কের ছাপ। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পুলিশ ও গোয়েন্দারা এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দোকানমালিক সাইদুল, নাসির ও কনক দাসকে। একপর্যায়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় আশুলিয়া থানায়। চেকপোস্টে থাকা শিল্পপুলিশের অন্য সদস্যদের ক্লোজ করে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীপুর পুলিশ লাইনে। জানা গেছে, চেকপোস্টের পার্শ্ববর্তী হোটেল ও চায়ের দোকানেই দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে খাওয়া-দাওয়া করেন ও বিশ্রাম নেন পুলিশ সদস্যরা। ছয়টি দোকানের একটি সাইদুল মিয়ার হোটেল। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে নিহত কনস্টেবল মুকুল হোসেনসহ বসে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিক, মুকুল হোসেন, মো, আপেল, পিনহারুজ্জামান, মো. ইমরান নামের শিল্পপুলিশের পাঁচ সদস্য। সকাল ৮টা থেকে নতুন টিমের সদস্য হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। ঠিক পৌনে ৮টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে করে দুজন দুর্বৃত্ত বাইপাইলের দিক থেকে উল্টোপথে নন্দনের দিকে এসে চেকপোস্টের সামনে মোটরসাইকেল পার্ক করে। তারা সাইদুলের খাবারের দোকানে বসে থাকা পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথাও বলে। মাত্র এক মিনিটের ব্যবধানে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ভদ্রবেশী দুর্বৃত্তরা। মুখোশ লাগিয়েই এক দুর্বৃত্ত মুকুলকে উপর্যুপরি কোপাতে শুরু করে। অন্যজন হাতে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করে। পরে ঘটনাস্থল থেকে দুটি গুলির খোসাও উদ্ধার করে পুলিশ। একপর্যায়ে দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে কনস্টেবল নূরে আলম দৌড় দিয়ে রাস্তার ওপারে চলে যান। তবে উপর্যুপরি দুর্বৃত্তদের চাপাতির কোপ খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে কনস্টেবল মুকুল দৌড় দিয়ে শুভেচ্ছা হোটেলে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নিরীহ পুলিশ সদস্য মুকুলের প্রাণভিক্ষা স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয় পাষণ্ডদের কঠিন হৃদয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাকি পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র ফেলেই প্রাণ বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী গজারিবনে পালিয়ে যান। গুরুতর অবস্থায় মুকুল ও নূরে আলমকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক মুকুলকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালের চিকিৎসক এম রফিকুল ইসলাম জানান, মুকুল ও নূর আলমের পেটে, মুখে ও বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই মারা যান মুকুল। নূরে আলমের ডান হাতে ও বুকের বাঁ দিকে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক আনিসুজ্জামান ও ডা. আসাদুল্লাহ রিপনের তত্ত্বাবধানে তার অস্ত্রোপচার হবে। ২৩ বছর বয়সী মুকুল হোসেন পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন ২০১২ সালে। তিনি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বাহুবল গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে।

 

 

আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের নন্দন পার্কের সামনে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে শিল্পপুলিশ কনস্টেবল মুকুল নিহত হন। ঘটনার পর গতকাল ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করেন পুলিশের অপরাধ বিশেষজ্ঞ দল      -বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন : বারইপাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রত্যক্ষদর্শী মো. লালন খান বলেন, ‘আমরা রাস্তার এইপারের হোটেলে বইস্যা নাশতা করতেছিলাম। এই সময় হাতে গুলি খাইয়্যা নূরে আলম নামের এক পুলিশ মাগো, মাগো কইয়্যা এই পারে আইয়্যা পড়ে। তহন বাসের কনডাকটর কনক দাস ও আমরা গামছা পেঁচাইয়্যা রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করি। পরে কনকই পুলিশ নূরে আলম ও মুকুলরে ভ্যানে কাইর‌্যা ফাতেমা হাসপাতালে লইয়্যা যায়।’

লালন বলেন, ‘রাস্তার এইপার থাইক্যা আমরা দেখি, মোটরসাইকেলের উপর খাড়াইয়্যা মুখোশ পরা একজন ফাঁকা গুলি করতাছে। পরে হেরা বাইপাইলের দিকে চইল্যা গেছে।’

একই কথা বলছিলেন আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রফিকুল ইসলাম ও বিল্লাল হোসেন। তারা বলছিলেন, ‘দুইটা পোলা মোটরসাইকেলে আইস্যাই প্রথমে গুলি করে। আরেকজন কোপানো শুরু করে। এইডা দেইখ্যা বাকি পুলিশ পালাইয়া যায়। পরে আমরা তাদের উদ্ধার কইর‌্যা লইয়্যা আহি।

হামলা চালাতে এলেই গুলিবিদ্ধ হবে : ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ওপর কেউ হামলা চালাতে এলেই গুলিবিদ্ধ হবে। যাদের স্বামী, ভাই কিংবা বাবা, তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, দয়া করে তাদের ওই পথ থেকে ফেরান। তারা অবশ্যই পরাজিত হবে। সম্প্রতি যারা একের পর এক মানুষ হত্যা করছেন, তারা কখনো রাষ্ট্রের শক্তির সঙ্গে পেরে উঠবে না। তারা কিছুই অর্জন করতে পারবে না।’ ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে  বলেন, ‘এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হবে। আমাদের অভিযান চলছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, জামায়াত-শিবির এ হামলার সঙ্গে জড়িত।’ শিল্পপুলিশ-১-এর উপ-পরিচালক কাওসার শিকদার বলেন, হামলাকারীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্র ছিনতাই। অস্ত্র নিতে না পেরেই তারা ছুরিকাঘাত করে।

দায়িত্ব না বুঝিয়ে দিয়েই... : বারইপাড়া চেকপোস্টে আশুলিয়া থানার একজন উপ-পরিদর্শকের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একেকটি টিম দুই শিফটে দায়িত্ব পালন করে। বাকি সদস্যদের রিকুইজিশন দিয়ে নিয়ে আসা হয় শিল্পপুলিশ থেকে। মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বারইপাড়া চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন টিমের। তার কাছ থেকে সকাল ৮টায় দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার কথা ছিল এসআই একরামের টিমের। তবে সকাল ৮টার আগেই এসআই হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন টিম চেকপোস্ট ত্যাগ করে চলে যায়। সুযোগ বুঝেই পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলে পড়ে দুর্বৃত্তরা।

তদন্ত কমিটি গঠন : চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তর ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন শিল্পপুলিশে কর্তব্যরত পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান ও ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজিম। জানা গেছে, কমিটি চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কর্তব্যে অবহেলা ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখবে।

শোকের মাতম : বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, দুর্ঘটনার পরপরই নিহত শিল্পপুলিশ কনস্টেবল মুকুলের বাড়ির সদস্যরা খবর পান। ঢাকা থেকে মুঠোফোনে কেউ একজন এ দুর্ঘটনার সংবাদ দিয়েছিলেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ শুনে শোকে জ্ঞানহারা হয়ে যান। গতকাল সকালে ঢাকার আশুলিয়ায় নিহত শিল্পপুলিশ কনস্টেবল মুকুলের গ্রামের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার রহবল উত্তরপাড়ায় চলছে শোকের মাতম। গতকাল বিকেল পর্যন্ত তার লাশ এলাকায় এসে পৌঁছায়নি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মুকুল নিহত হওয়ায় বাবা শহীদুল ইসলাম বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। মা মোর্শেদা বেগম বাক হারিয়ে ছেলের ছবি হাতে শুধু তাকিয়ে আছেন। ছোট ভাই জিসান বাবু, ছোট বোন মিষ্টি ও শম্পা প্রলাপ বকে যাচ্ছেন। প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দিলেও শোক থামছে না। ছয় সদস্যের সংসারে বাবা শহীদুল ইসলাম অন্যের জমি চাষাবাদ করেন। মা মোর্শেদা গৃহিণী। জিসান বাবু রংপুর কারমাইকেল কলেজে একাদশ শ্রেণিতে, ছোট বোন শম্পা স্থানীয় রহবল দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে এবং সবার ছোট বোন মিষ্টি রহবল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। নিহত মুকুলের ভাই জিসান বাবু জানান, প্রায় চার বছর আগে মুকুল পুলিশে যোগ দেন। এর পর থেকে তার বেতনের টাকায় চলত সংসার। ছোট ভাই ও বোনদের পড়াশোনার খরচসহ যাবতীয় খরচ চলত। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শুধু মুকুলই ছিলেন উপর্জনকারী। এখন সংসার চলবে কী করে। তিনি বলেন, ‘দুর্বৃত্তরা ভাইকে মারেনি, মেরেছে পুরো পরিবারকে।’ তিনি জানান, মাত্র চার বিঘা জমি তার বাবার সম্পদ। এর মধ্যে ১৫ শতক জায়গার ওপর বসতবাড়ি। বাকি সম্পত্তি অভাবের কারণে বন্ধক রাখা হয়েছে। মুকুল সেসব সম্পত্তি ধীরে ধীরে টাকা দিয়ে ছাড় করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা আর পারলেন না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর