শিরোনাম
রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সেই ৭ নভেম্বরে আমাদের যা হলো

কর্নেল অব. জাফর ইমাম, বীরবিক্রম

সেই ৭ নভেম্বরে আমাদের যা হলো

সন্ধ্যার পর রংপুর সেনানিবাসে যখন গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল তখন আমি সেনানিবাসে কয়েকজন অফিসারসহ মেজর হারুনের বাসায় (সাবেক সেনাপ্রধান) বসে ওই অবস্থায় পরবর্তী করণীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে আলাপ করছিলাম। ওই বাসায় বসেই আমার ১৫ বেঙ্গল ইউনিটকে নির্দেশ দিলাম যেন পাল্টা কোনো কিছু না করে শুধু ইউনিটের চারপাশে অবস্থান গ্রহণ করে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকে এবং কারও উসকানির কারণে যেন কোনো সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়। আমি ইউনিটকে এও জানালাম যে, ইউনিটের বাকি অফিসারদের আমি ইউনিটে পাঠিয়ে দিচ্ছি এবং আমাকে হয়তো ঢাকায় যেতে হতে পারে। মেজর হারুনের বাসায় বসে আমরা যে কোনো সংঘর্ষ এড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম এবং সবাই একমত হলাম যে, আমি যেহেতু মূল টার্গেট সে জন্য ঢাকায় যাওয়ার অজুহাতে আগামী কয়েক দিন ইউনিটের বাইরে থাকাই আমার জন্য বাঞ্ছনীয় হবে। আমি যদি ইউনিটে থাকি আর আমার জন্য যদি অন্য কোনো ইউনিট থেকে ১৫ বেঙ্গলের ওপর কোনো আঘাত আসে তাহলে সে ক্ষেত্রে ব্যাপক রক্তপাত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। ওপরের সিদ্ধান্তের পেছনে এটাই ছিল মূল কারণ। আমি অফিসারদের ইউনিটে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে সেনানিবাসের বাইরে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করি। কয়েকজন অফিসার আমার সঙ্গে সেনানিবাসের বাইরে রংপুর মেডিকেল কলেজের শেষ সীমানা পর্যন্ত আসেন এবং সেখান থেকে আমি তাদের ইউনিটে ফিরে যেতে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলাম, ‘তোমরা যে কোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্যের পরিচয় দেবে, কোনো সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেবে না, আমার সম্পর্কে ইউনিটের অথবা ঢাকা থেকে কেউ জানতে চাইলে বলবে ইতিমধ্যেই আমি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছি।’ আমি রংপুর মেডিকেল কলেজের পেছনের একটি বাসায় উঠি। সেখানে তাদের পরিস্থিতি উলে­খ করে আমাকে কিছু সিভিল পোশাক দেওয়ার অনুরোধ জানালে তারা আমাকে একটি শার্ট ও একটি প্যান্ট প্রদান করেন। আমি আমার ইউনিফর্ম পরিবর্তন করে ওই শার্ট-প্যান্ট পরিধান করে কোথায় নিরাপদ থাকা যায় সে ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সে বাসা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কমপক্ষে ১০ মাইল দূরে যে কোনো একটি গ্রামে গিয়ে আত্মগোপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। রাত প্রায় ৯টা-১০টা হবে। তখন রংপুর সেনানিবাসসহ রংপুর শহরে মিছিল ও গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে আমি ও আমার অফিসাররা শহরে আমাদের পরিবারবর্গ যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল ওই জায়গায় কোনো আক্রমণ হলো কিনা সে ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় রইলাম। তাদের কাছ থেকে পরে শুনলাম তারা শহরে এ ব্যাপক গোলাগুলি ও মিছিলের মধ্যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিন-চারটি বাসা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ যে বাসায়ই যাচ্ছিল সেনা অফিসারের পরিবার বিধায় তাদের ওপরও আক্রমণ আসতে পারে এ ভয়ে অনেকে আশ্রয় দিতে তাদের অপারগতা জানায়। অফিসারদের এই পরিবারগুলো সতর্কতার সঙ্গে একের পর এক বাসা পরিবর্তন করে সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। এক পর্যায়ে একটি বাসা থেকে বেরিয়ে অনেক দূর হেঁটে এসে অন্য আরেকটি বাসায় যাওয়ার উদ্দেশে যে মুহূর্তে তারা রাস্তা অতিক্রম করবে ঠিক সে মুহূর্তে কয়েকশ’ গজের মধ্যে সৈনিকদের একটি ট্রাকমিছিল গুলিবর্ষণ করতে করতে ওই রাস্তা দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছিল। তারা সবাই অত্যন্ত ক্লান্ত থাকা সত্তে¡ও সাহস, ধৈর্য ও বুদ্ধির সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। ওই রাস্তার পাশে একটি বাস পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়া ছিল। তারা সবাই ওই মিছিলের ট্রাকের হেডলাইটের আলোতে পড়ার আগেই ওই বাসের নিচে ও রাস্তার ঢালে শুয়ে পড়ে। আল্লাহর রহমত বলতে হবে, ট্রাকমিছিলটি তাদের অতিক্রম করে চলে গেল। মিছিল থেকে কেউ তাদের দেখেনি। যদি দেখত তাহলে হয়তো একটি করুণ দৃশ্যের অবতারণা হতে পারত। আমার শ্যালক আরজু ও ক্যাপ. রহমান ১২ নভেম্বর রংপুর থেকে ভোরে ট্রেনে করে ওই পরিবারগুলো নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। রংপুর স্টেশনে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিটি ট্রেন তল্লাশি হচ্ছিল। সে অবস্থায় কেউ বোরকা পরে, কেউ বা বড় ঘোমটা দিয়ে সাধারণ পুরুষ ও মহিলা যাত্রীদের সঙ্গে সবাই মিশে গিয়েছিল এবং স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত আমার শ্যালক ও ক্যাপ. রহমান ট্রেনের দুটি কম্পার্টমেন্টের দুটি টয়লেটে নিজেদের লুকিয়ে রেখে জীবন রক্ষা করেন। এদিকে আমি রংপুর মেডিকেল কলেজের পেছনের ওই বাসা থেকে সিভিল কাপড় পরিধান করে সিঅ্যান্ডবির একজন কর্মচারীর সহযোগিতায় শহর থেকে অনেক দূরে একটি বিল এলাকায় ছোট একটি গ্রামে ওই কর্মচারীর এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিই। তখন রাত গভীর। চারদিকে নিস্তব্ধতা। চাঁদনি রাত। ওই বাড়ির অদূরে প্রশস্ত বিলের পানিতে চাঁদের আলো ঝিকমিক করছিল।

বাড়িওয়ালা গরিব হলেও তার মনটা ছিল খুব বড়। তিনি আমাকে আদর-যত্ন ও মেহমানদারি করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন এবং আমার থাকার ব্যবস্থা করে কিছু মুড়ি ও গুড় খেতে দিলেন। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, আমার এ অবস্থান সম্পর্কে যেন গ্রামের কেউ না জানতে পারে এবং সে ব্যাপারে তিনি যেন বাড়ির সবাইকে সতর্ক করে দেন। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, কেউ জানবে না, আপনি এ ব্যাপারে চিন্তা করবেন না। ১০ তারিখে আমি ওই কর্মচারীকে রংপুরে তার অফিসে যেতে না দিয়ে আমার সঙ্গে রাখলাম। বেলা প্রায় ৩টা-৪টা হবে, হঠাৎ করে ওই গ্রামের ওপর একটি হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি প্রথমে ধারণা করেছিলাম, যেহেতু জিপ ও ট্রাকযোগে রংপুর থেকে এ অঞ্চলে আসা সম্ভব নয় হয়তো সে কারণে হেলিকপ্টার থেকে সৈন্য অবতরণ করে আমার বিরুদ্ধে অপারেশন চালাবে। হেলিকপ্টারটি ওই গ্রামের এক প্রান্তরে অবতরণ করল। ইতিমধ্যেই আমার সঙ্গের ওই কর্মচারী গ্রাম থেকে খবর নিয়ে এলো যে, ওই হেলিকপ্টারটি করে ঢাকা থেকে এক সৈনিকের লাশ এসেছে। আমরা তখন ওই বাড়িগুলো থেকে ক্রন্দন বিলাপ ও আর্তনাদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি তখন ওই কর্মচারীকে বললাম, এ গ্রামে আর থাকা যাবে না। কারণ যেহেতু গ্রামে এই সৈনিকের মৃত্যুতে একটি শোকের ছায়া ও ক্ষোভ বিরাজ করছে, পাশাপাশি এ-সংক্রান্ত একটি বিভ্রান্তিও সবার মধ্যে রয়েছে, এ মুহূর্তে আমার ব্যাপারে যদি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে হয়তো আমি গ্রামবাসীর ভুল বোঝাবুঝি ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের শিকার হতে পারি। ওই কর্মচারী আমার সঙ্গে এ যুক্তিতে একমত হলো এবং সন্ধ্যার পর আমাকে কয়েক মাইল দূরে আরেকটি গ্রামে তার আরেক আত্মীয় বাড়িতে নিয়ে যায়। এভাবে ওই বাড়িতে প্রায় ১০-১২ দিন অবস্থান করি এবং ওই কর্মচারীর মাধ্যমে আমি রংপুরের দৈনন্দিন খবরাখবর নিচ্ছিলাম। সে প্রতিদিন তার কর্মস্থল রংপুরে অফিস করে ফিরে আসত এই গ্রামের বাড়িতে। তার মাধ্যমে আমি রংপুরে আমার এক ভাগিনা নাজুকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য খবর পাঠাই। সে একদিন এসে বলল, নাজুর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং সে বাসায় আমার আরেক শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা ওবাইদুল হক ঢাকা থেকে এসে আমার খোঁজে ওই বাসায় অবস্থান করছেন। সে আমাকে বলল, আমি যে বেঁচে আছি আমার শ্যালক সেটাই বিশ্বাস করতে পারছিল না। শ্যালক নাকি গুজব শুনেছে যে ওইদিন রাতে রংপুরে আমাকে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে। আমি পরদিন আবার তার মাধ্যমে খবর পাঠালাম, আমি না বলা পর্যন্ত তারা যেন আমার এই গোপন আস্তানায় না আসে। রংপুর থেকেই কী করে আমি ঢাকা যেতে পারি তা তারা আমাকে জানাবে। তার পরই শুধু ঢাকা যাওয়ার চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যে প্রায় দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে। আমার শ্যালক রংপুরের ওই বাসায় থেকে ওই কর্মচারীর মাধ্যমে আমাকে জানালেন যে, খালেদের পক্ষের অনেক অফিসারকে ঢাকায় বন্দী অবস্থায় গণভবনে রাখা হয়েছে। কর্নেল শাফায়াত জামিল ও বিমানবাহিনীর অফিসাররা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। তিনি আরও জানালেন, যেসব অফিসার এখনো বাইরে রয়েছেন তারা যদি ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে সেনাবাহিনীতে রিপোর্ট না করেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং তাদের ভবিষ্যৎ জীবন ও নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব কারও থাকবে না।

আমার সঠিক তারিখ মনে নেই, সম্ভবত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হবে, ভাগিনা নাজুকে নিয়ে রংপুরের ওই গ্রাম থেকে ট্রেনে, বাসে ও বিভিন্নভাবে ছদ্মবেশে খুলনা শহরে আসি। খুলনা শহরে ওই রাতে ফাল্গ–নী অথবা বেগুনি নামের একটি হোটেলে উঠি। তখন আমার ও ভাগিনা নাজুর কাছে ঢাকায় পৌঁছার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব ছিল এবং আমার পরনের বস্ত্র ছাড়া আর কোনো পোশাক আমার ছিল না। হাদি নামে কর্নেল হুদার এক আত্মীয় খুলনায় থাকতেন। রংপুর থেকে প্রায় সময় কর্নেল হুদা ও মাঝেমধ্যে আমি টেলিফোন করে কুশল বিনিময় করতাম। হোটেলে বসে ওইদিন হঠাৎ করে তার টেলিফোন নম্বর মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ওই নম্বরে তার বাসায় ফোন করি। সে তখন বাসায় ছিল না। হাদি ভাইয়ের মায়ের কাছে আমার হোটেলের ফোন নম্বর দিয়ে অনুরোধ করে রেখেছিলাম হাদি ভাই বাসায় এলে যেন আমার ওই নম্বরে ফোন করেন। কিছুক্ষণ পর হাদি ভাই হোটেলে ফোন করলেন। আমি তাকে একটি শার্ট, প্যান্ট ও ৫০০ টাকা নিয়ে হোটেলে আসার অনুরোধ জানালাম এবং বললাম সাক্ষাতে বিস্তারিত আলেচনা হবে। এর কিছুক্ষণ পর তিনি হোটেলে এসে আমাকে ৫০০ টাকা এবং একটি শার্ট ও একটি প্যান্ট প্রদান করলেন। তার সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলাম। তাকে স্টিমারে ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে রাতের মধ্যেই যে কোনো স্টিমারে একটি কেবিন বরাদ্দ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জনালাম। স্টিমারে ঢাকায় যাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। হাদি ভাই আমাদের ওই রাতেই স্টিমারের কেবিনে পৌঁছে দিয়ে এলেন। পরদিন সকালে ঢাকা এসে পৌঁছে আমি সরাসরি এলিফ্যান্ট রোডে আমার বাসায় না এসে ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের কাছে আমার ছোট বোন ডা. নাজনিন ইসলামের বাসায় উঠলাম এবং সেখান থেকে সেনা সদরে ডিএমআই ব্রিগেডিয়ার মহসীনকে টেলিফোন করে সর্বশেষ আমাদের সম্পর্কে কী নির্দেশ রয়েছে তা জানার চেষ্টা করি। তিনি আমাকে জানালেন, ‘সব ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই, তুমি সেনা সদরে চলে আস, আসলে সাক্ষাতে সব আলাপ হবে।’ আমার একজন পরিচিত অফিসারসহ একটি জিপ পাঠানোর জন্য আমি তাকে অনুরোধ করলাম। তিনি কয়েকজন অফিসারের নাম উলে­খ করে জিজ্ঞাসা করলেন এদের মধ্যে কাকে পাঠালে তুমি খুশি হবে। আমি তাকে বললাম লে. কর্নেল মাহবুবকে আনন্দ সিনেমা হলের সামনে পাঠাতে। ইচ্ছা করে আমি বাসার ঠিকানা গোপন রাখলাম, অবস্থা ও পরিস্থিতি বোঝার জন্য। আমার বোনের বাসা থেকে আনন্দ সিনেমা হল দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর দেখি একটি আর্মির জিপ সিনেমা হলের সামনে থামল এবং জিপ থেকে কর্নেল মাহবুব নেমে আশপাশে পায়চারী করছিল। আমি বুঝলাম সে আমার অপেক্ষায় আছে। আমি ফোনে আমার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় ইতিমধ্যেই আলাপ সেরে নিয়েছিলাম। বোনের বাসা থেকে আমি সরাসরি তার জিপের সামনে এলে কর্নেল মাহবুব আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন। আমি ওই জিপে করে সেনা সদরে ব্রিগেডিয়ার মহসীনের কক্ষে এলাম। তিনি আমাকে চা ও বিস্কিট দিয়ে আপ্যায়ন করলেন এবং আমাকে জানালেন যে, সেনা সদর থেকে আমাকে গণবভনে যেতে হবে। আমি তাকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম আমাকে ২-১ ঘণ্টা সময় দেওয়ার জন্য যাতে আমি এলিফ্যান্ট রোডে আমার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসতে পারি। তিনি বললেন, এখন আর সম্ভব নয়। পরিবার ইচ্ছা করলে অনুমতি নিয়ে পরে গণভবনে দেখা করতে পারবে। আমি উত্তেজিত হয়ে তাকে বললাম, ‘হেল্ উইথ ইউ! আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গণভবনে পাঠানোর ব্যবস্থা কর।’ কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি অফিসার্স এসকর্ট দিয়ে আমাকে গণভবনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। গণভবনে এসে পৌঁছলাম। এসকর্ট অফিসার আমাকে গণভবনের দোতলায় নিয়ে গেলেন। ওই ফ্লোরের একটি কক্ষে শেখ সাহেবের অফিস ছিল। বাকি কক্ষগুলোতে তোফায়েল, কর্নেল জামিল ও অন্য অফিসাররা বসতেন। শেখ সাহেবের অফিসকক্ষটি তালাবদ্ধ ছিল; বাকি অফিসকক্ষগুলো কর্নেল মালেক, কর্নেল গাফফার, মেজর হাফিজ, মেজর নাসির, ক্যা. হাফিজ উল্যা, ক্যা. হুমায়ুন, ক্যা. তাজ, মেজর আমিনুল ইসলাম ও মেজর ইকবালসহ অন্যরা বিভিন্ন রুমে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। প্রত্যেক রুমের সামনে সেনারক্ষী ছিল। আমার উপস্থিতির খবর শুনে সবাই নিজ নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। কর্নেল মালেক তখনো তার রুমে বসে কোরআন তিলাওয়াত করছিলেন। কিছুক্ষণ পর কর্নেল মালেকের কোরআন তিলাওয়াত শেষে আমি তার কক্ষে গিয়ে তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলাম। অতঃপর আমাকে কর্নেল গাফফারের রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। প্রায় তিন মাস আমরা গণভবনে বন্দী অবস্থায় ছিলাম। প্রায় প্রতিদিন অমারা নিজেদের মধ্যে পরিস্থিতি ও পরবর্তী কৌশল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। অন্যদিকে সেনাবাহিনীতে আমাদের বিচারকাজ শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। আমরা জানতাম, বিচার হবে শুধু দেখানোর জন্য। আমাদের ফাঁসি কার্যকর করার জন্য যথার্থতা প্রমাণ করাই ছিল এই বিচারের উদ্দেশ্য। আমরা অনেকেই বিভিন্ন তদন্তের সম্মুখীন হচ্ছিলাম। তখন অনেক জেনারেলের উক্তি আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, আমাদের মধ্যে একটি অংশকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসি দেওয়া হবে এবং আরেকটি অংশকে দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হবে। গণভবনে বন্দী থাকা অবস্থায় আমাদের পরিবারকে মাঝেমধ্যে দেখা করার অনুমতি প্রদান করা হতো। পরিবারের সদস্যরা আমাদের ব্যাপারে আশা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিলেন। যখনই তারা আসতেন তাদের খুবই বিষণœ ও হতাশাগ্রস্ত মনে হতো। আমরা তাদের সাহস ও মনোবল ঠিক রাখার জন্য উৎসাহ দিতাম। একদিন মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী গণভবনে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এসে সবার উদ্দেশে বললেন, অতি তাড়াতাড়ি তোমাদের সবার বিচারকাজ শুরু হবে। ইচ্ছা করলে তোমরা নিজস্ব উকিল রাখতে পারবে, এ ছাড়া সবাইকে অভিযুক্ত করে তিনি অনেক কট‚ক্তি করলেন। শওকতের কথায় সবাই উত্তেজিত হয়ে কঠিন ভাষায় তাকে অনেক পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন। তাকে বলা হলো, ‘যাই করবেন কিছুই আন্চ্যালেঞ্জড যাবে না। আমাদের উকিলের প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেরাই নিজেদের উকিল। আপনি এখান থেকে চলে যেতে পারেন।’ কয়েকজন চিৎকার করে শওকতকে এ কথাগুলো শোনালেন। এর কিছু দিন পর কালো চশমা পরিহিত জেনারেল মঞ্জুর এলেন। তিনি খুব ঠাণ্ডা প্রকৃতির লোক। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নে তিনি মতবিনিময় করছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি মেজর নাসিরকে প্রশ্ন করলেন, ‘ডালিমদের প্রথম অভ্যুত্থানে তুমি শরিক হতে পারনি, সে জন্য কি ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে খালেদের এই অভ্যুত্থানে শরিক হলে?’ মেজর নাসির মৃদু হেসে বলল, ‘আপনার এ ধারণা সঠিক নয়। আমি অনেক আগে থেকেই খালেদের এই অ্যাকশনের অপেক্ষায় ছিলাম। আসলে আপনি সেনাবাহিনী ও দেশের খবরাখবর পুরোপুরি রাখেন না।’ মেজর নাসির ভারতে একটি প্রশিক্ষণ কোর্স করছিলেন। ৩ নভেম্বরের খবর শুনেই ওই কোর্স সমাপ্ত না করেই ভারতের ওই স্কুল থেকে ৩ নভেম্বরে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করার জন্য দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পালিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে। মঞ্জুর এসেছিলেন জিয়ার পক্ষ থেকে আমাদের তখনকার মনমানসিকতা পরীক্ষা করার জন্য, সবার মধ্যে উত্তেজিত মনোভাব দেখে মঞ্জুরও আমাদের থেকে বিদায় নিলেন। কর্নেল শাফায়াত জামিল ও এয়ার ফোর্সের অফিসাররা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবে সবার ভাগ্যের পরিণতি একই হবে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর ওই ফ্লোরে যেসব বেয়ারার কাজ করত তারাই আমাদের খাওয়া সরবরাহ করত। তারা আমাদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ছিল। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দিনে দিনে খুবই গভীর হয়ে ওঠার পর আমরা অনেক গোপনীয় কথা তাদের সঙ্গে আলাপ করতাম। তারা সবাই শেখ সাহেবের ভক্ত ছিল। ১৯৭৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে যখন আমরা বুঝলাম যে সেনা কর্তৃপক্ষ আমাদের ব্যাপারে যে কোনো মুহূর্তে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তখন আমরাও গণভবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। একদিন হঠাৎ নির্দেশ এলো, কর্নেল পদবির উপরের অফিসারদের আজই ঢাকা সেনানিবাসে ডিএফআই সেলে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই নির্দেশ মোতাবেক আমাদের ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হলো। যাওয়ার সময় আমরা মেজর হাফিজ, ক্যা. তাজ, মেজর ইকবাল, ক্যা. হুমায়ুন ও ক্যা. হাফিজ উল্যাকে বলে গেলাম, তোমরা তোমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাবে। আমরাও সেনানিবাস থেকে বিভিন্ন উপায়ে খবরাখবর পৌঁছানোর চেষ্টা করব। পালিয়ে যাওয়ার মূল পকিল্পনাকারী ও রূপকার যেহেতু তারাই ছিল সে জন্য সেদিন এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করার প্রয়োজন আমরা মনে করিনি।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর