শিরোনাম
সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

উৎসাহ নেই বিনিয়োগের

উৎকণ্ঠা বর্তমান পরিস্থিতিতে ♦ ব্যবসায়ীরা হতাশ ♦ ঘাটে ঘাটে হয়রানি

রুহুল আমিন রাসেল

উৎসাহ নেই বিনিয়োগের

বিনিয়োগে উৎসাহ নেই দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের। ঘাটে ঘাটে ভয়াবহ হয়রানি, ব্যবসায়ীদের ওপর নানামুখী খড়গ ও উৎকণ্ঠার রাজনীতির কারণে তারা উৎসাহ হারিয়েছেন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সুশাসন, নানামুখী দুর্নীতি ও অনিয়ম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে গার্মেন্ট খাতে সংকট বেড়েছে অনেক। অনেক ক্রেতা এখন ঢাকায় আসতে চাইছেন না নিরাপত্তার অজুহাতে। তারা অবস্থান নিয়েছেন হংকং, ব্যাংকক ও দুবাইয়ে। বিক্রেতাদের ডাকছেন সেখানেই। বিক্রেতারাও ছুটছেন সেখানে। এর বাইরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ভয়াবহ হুমকিতে দেশের শিল্প-বাণিজ্য। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভয়াবহ হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। তারা ব্যবসা শুরুর জন্য ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ থেকে আরম্ভ করে কর পরিশোধ পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে সংকটে পড়ছেন। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারেন না। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে চরম হয়রানির কারণে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে।

সূত্রমতে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন হতাশ। নতুন বিনিয়োগে কারও উৎসাহ নেই। বড় ব্যবসায়ীদের নতুন করে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেকের ওয়ান-ইলেভেনের মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দূরত্ব বাড়ানো হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে তা করা হচ্ছে কি না এ প্রশ্নও অনেকের। অকারণে ঝামেলার কারণও অনেকের কাছে স্পষ্ট  নয়। অনেক বিষয় নিয়েই তাড়াহুড়ার কারণও প্রশ্নবিদ্ধ। আওয়ামী লীগের আগের আমলে অনেক দেশীয় বড় ব্যবসায়ীর বড় শিল্প প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ। এ আমলেও একই ধারা বহাল। বাস্তবে ওসব জমি সরকার কোনো কাজেই লাগায়নি। একই অবস্থা চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেডে। সেখানকার বেশির ভাগ সমস্যা সরকারি দলের লোকজনের তৈরি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাজই হচ্ছে কোরিয়ান ইপিজেডকে হয়রানি ও তাদের জমি দখল। এর বাইরে বিভিন্ন অনুমতি নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের আটকে রাখা হয়েছে। অথচ সরকার বিদেশে ঘুরে ঘুরে আহ্বান জানাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগের। কিন্তু বাস্তব সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু  বিদেশি বিনিয়োগ নয়, একইভাবে দেশি শীর্ষ অনেক ব্যবসায়ী নানাভাবে হয়রানির শিকার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনেকের পেছনে লেগেছে। আবাসনশিল্পে ধস নেমেছে। ভারী ও হালকা শিল্পে মন্দা ভাব কাটছে না। অনেক ব্যবসায়ী তাদের শিল্প বিক্রি করে দিচ্ছেন। স্টিল মিল বিক্রি করেছেন এর মধ্যে অনেকে। গার্মেন্ট খাতও ভালো যাচ্ছে না। আলাপকালে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেই। গ্যাসের সংযোগ নেই। বিদ্যুতের চাহিদাও মিটছে না। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো নয়। প্রভাবশালীদের অনেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। আবার ভালো ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে ঠাঁই পান না। আমলাতন্ত্র সরকারের ঘাটে ঘাটে। সরকারি দফতর থেকে দফতরে ঘুরে ক্লান্ত অনেকে। পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে ভোগান্তি তো আছেই। সব মিলিয়ে কঠিন অবস্থার দিকে যাচ্ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য।

এ প্রসঙ্গে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য জ্বালানি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছেন। তাই সরকার জ্বালানি সমস্যা সমাধানের নিশ্চিয়তা দিলে বিনিয়োগের অভাব হবে না।

বাংলাদেশে প্রত্যাশিত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শিল্প প্রতিষ্ঠায় যে সুযোগ-সুবিধা চান, সরকার তা দিতে পারে না। অথচ বিশ্বের যে কোনো দেশে এসব সুযোগ-সুবিধা মেলে সহজেই। যেমন বিনিয়োগকারীরা জমি চাইলে সেটি সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে পারে না। পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, অবকাঠামোসহ অন্যান্য সমস্যা তো লেগেই আছে। সেই সঙ্গে দুর্নীতি, সুশাসন ও আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের সমস্যাও ব্যাপক।

সম্প্রতি দেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন জরিপে দেখা গেছে, দেশের ব্যবসায়ীদের একটি অংশ মনে করেন, এখানে ব্যবসা করার মতো সহায়ক পরিবেশ নেই। এই মত জরিপে অংশ নেওয়া ৬২ শতাংশ ব্যবসায়ীর। জরিপের তথ্যমতে, দেশের ৯১ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঘুষ দিতে হয়। ৮৪ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, সরকারি সেবা পেতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঘুষ দিতে হয়। ৮৯ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, কর পরিশোধের সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঘুষ দিতে হয়। আর ৮৮ শতাংশ বলেছেন, সরকারি চুক্তি কিংবা লাইসেন্স পেতেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঘুষ দিতে হয়। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে সরকারি সেবা যথেষ্ট নয় দাবি করে সিপিডির ওই জরিপে আরও বলা হয়, সরকার খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যবসা করার জন্য একটি টেকসই নীতি দিতে পারে।

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে এখন বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এত দিন জমির স্বল্পতা, উচ্চ সুদ, গ্যাস সংযোগের অভাব ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর সংকট ছিল। তবে আশার কথা হলো, সরকার কিছু কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন দরকার মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। এর সঙ্গে পরিবহন ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর জন্য সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয় বলেও মত দেন এই শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা।

এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নতুন বিনিয়োগ এখন আরও কমবে। বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকের তারল্য আরও বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী। আমরা শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য করব। এ জন্য গ্যাস-বিদ্যুৎ লাগবে। কিন্তু এখন নতুন করে গ্যাসভিত্তিক কারখানা স্থাপন সম্ভব নয়। একদিকে উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে প্রচুর পরিমাণে অলস টাকা পড়ে আছে। দেশের রিজার্ভ এখন আকাশচুম্বী। বিনিয়োগ নেই বলে এমন রিজার্ভ আছে।’

বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. মামুন রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিনিয়োগের পরিস্থিতি খুব খারাপ এ কথা বলা যাবে না। তবে মধ্য আয়ের প্রত্যাশা অনুযায়ী আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। মোট দেশজ সম্পদের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৭ শতাংশে উন্নীতকরণে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করতে হবে। এ বিনিয়োগ আসবে বেসরকারি খাত থেকে। এখানে বিনিয়োগের প্রধান সমস্যা গ্যাস সংযোগ। শিল্পের উৎপাদন খরচ কমাতে প্রয়োজন গ্যাস। বিদ্যুৎ সমস্যা অনেকটা কমলেও এখনো ক্যাপটিভ পাওয়ার চালাতে হচ্ছে। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) ‘বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন, ২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০১৪ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ কমেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে নিট ১৫২ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা ২০১৩ সালে ছিল ১৫৯ কোটি ৯১ লাখ ডলার। এই বিনিয়োগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে উপার্জিত আয়কে পুনর্বিনিয়োগ করার মাধ্যমে। এভাবে বিনিয়োগ হয়েছে ৯৮ কোটি ৮৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এ ছাড়া ‘ইক্যুইটি’ বা নিজস্ব মূলধন এসেছে ২৮ কোটি তিন লাখ ১০ হাজার ডলারের। আন্তকোম্পানি ঋণের মাধ্যমে এসেছে ২৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর