সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

খুনির সঙ্গে সংলাপ নয় : প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি

খুনির সঙ্গে সংলাপ নয় : প্রধানমন্ত্রী

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জাতীয় সংলাপের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো খুনির সঙ্গে সংলাপে বসার ইচ্ছা নেই। আর কীভাবেই বা বসব? যার পাশে বসলে পোড়া মানুষের গন্ধ তার সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেন, দয়া করে আপনারা আমাকে কেউ খুনির সঙ্গে সংলাপে বসতে বলবেন না।

নেদারল্যান্ডস সফর শেষে দেশে ফেরার পর গতকাল দুপুরে গণভবনে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। সংলাপ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, যখন সত্যিকারভাবে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির সুযোগ এসেছিল, তখন তিনি সাড়া দেননি। নির্বাচন বানচাল করার জন্য তিনি পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছেন। তার কাছে গেলেই এখন পোড়া মানুষের গন্ধ পাব। তিনি নির্বাচন বর্জনই কেবল করেননি, মানুষকে হত্যা করেছেন। প্রিসাইডিং অফিসার পর্যন্ত ?পুড়িয়েছেন। যখন জাতির প্রয়োজন ছিল তখন তার সাড়া আসেনি। এখন বাংলাদেশে এত রাজনৈতিক দৈন্যতা পড়েনি যে খুনির সঙ্গে বসতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, আপনি যদি কারও বাড়ি যান, আর আপনার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আপনি তার বাড়ি আর যাবেন? তিনি আরও বলেন, রাজনীতি করলেও আমি মানুষ। আমার একটি দল আছে, দেশ আছে। আমার ব্যক্তিগত মর্যাদারও বিষয় আছে। খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি তাকে ফোন করেছিলাম। ফোন করে কী ধরনের কথা শুনতে হয়েছে? কী ধরনের ঝাড়ি মেরেছেন? তারপরও আমি ওনাকে বলেছিলাম, আসুন সর্বদলীয় সরকার গঠন করি। যে যে মন্ত্রণালয় চান দেব। আর উনি যদি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত। বর্তমানে যে বিচার হচ্ছে তা ঠিক। এটা সমর্থন করি। এ কথাটা উনার মুখ থেকে এলে তখনই বসার যোগ্যতা অর্জন করবেন। তখনই ভেবে দেখব। আর আমাকে যারা সংলাপে বসতে বলেন, তাদের বলব, উনি কী তাদের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবেন, যারা আন্দোলনের আগুনে পুড়ে জীবন দিয়েছেন। যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, তাদের সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে। চলমান পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে সতর্কতার কথা উল্লেখ করে একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, আমাদের লেখার স্বাধীনতা কতটুকু পর্যন্ত নিশ্চিত হবে? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লেখার ব্যাপারে কোনো সতর্কতা কিংবা নিষেধাজ্ঞা নয়। এ সময় ধর্ম নিয়ে বিকৃত রুচির লেখালেখি না করারও পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, কারও ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত লাগে এ ধরনের লেখা যেন না হয়। আমরা ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু সেক্যুলারিজম মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্ম নিয়ে কেউ বিকৃত কিছু লিখলে আমারও সেন্টিমেন্টে লাগে। কেউ ধর্ম মানবে কি মানবে না, সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু অন্যের ধর্মে আঘাত দিতে পারবে না। বিকৃত লেখা মানবিক গুণ নয়। কারও অনুভ‚তি যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখাই মানবিকতা। লেখক-প্রকাশক-ব্লগার হত্যার বিচার প্রসঙ্গে আরেক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, লেখক-ব্লগার হত্যাকারীরা ধরা পড়ছে। তদন্ত হচ্ছে। খুনিদের কোনো তথ্য দিলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অবশ্যই সব খুনের বিচার হবে। সাম্প্রতিক বিদেশি হত্যা ও গুপ্তহত্যা কী শুধুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি রাজনৈতিক সংকট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি? এসব ঘটনায় সরকার আস্থার সংকটে পড়তে পারে কিনা বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ফ্লোরিডায় মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। কেন এই প্রবাসীকে সেখানে হত্যা করা হলো, সে প্রশ্ন কি আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে আপনি করতে পারবেন? নিরাপত্তা নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কথায় আছে, বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। সবাইকে সাহস রাখতে হবে। খুনের কত তালিকা হয়। ১৯৮১ সালে যেদিন দেশের মাটিতে পা রেখেছিলাম, সেদিন থেকেই সব তালিকার শীর্ষে রয়েছি আমি। আমি তো ভীত নই। এমনিতেই গভীর চক্রান্ত চলছে এ দেশকে অনিরাপদ প্রমাণ করতে। নিজেরা সতর্ক-সাহসী না হলে চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু নিরাপত্তা দেওয়া দরকার, তা দেওয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন,  বাংলাদেশ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ দেশ, মোটেই অনিরাপদ নয়। যখনই যেখানে যা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তা সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছি তখন বাংলাদেশ অনিরাপদ বলে একটা আওয়াজ তোলার চেষ্টা হচ্ছে।

বাংলাদেশকে সিরিয়া, মিসর, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান বানানোর জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি দেশীয় ষড়যন্ত্রও আছে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ-আইএস নামে একটা আর্টিফিশিয়াল গোলমাল তৈরির চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকে কোনোভাবে যদি অনিরাপদ করা যায়, জঙ্গি আছে, আইএস আছে এটা যদি স্বীকার করানো যায় তাহলে বাংলাদেশে হামলা করা যায়, এ পরিকল্পনা কিন্তু অনেকেরই আছে। দেশবাসী সচেতন না হলে সর্বনাশ হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগুনে জ্বালাও-পোড়াও করে মানুষ মেরে যখন উদ্দেশ্য সফল করতে পারেনি, তখন এবার গুপ্তহত্যা চলছে। হত্যাকাণ্ড তো পরিকল্পিকভাবে ঘটানোই হচ্ছে। এদেশে আইএস আছে বলে প্রমাণের চেষ্টা চলছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি নেত্রীর সংলাপ ও নির্বাচনের যে দাবি করছেন তার যোগসূত্র রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। আমরা চাই না এদেশ অস্থির ভ‚খণ্ড হোক। তিনি বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে মূলত একটি দল অর্থায়ন করছে, আর মাঠে খুন-খারাবির কাজ আরেকটা দল করছে। এর বেশ কিছু তথ্য আছে, আরও তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা হচ্ছে।

যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক বিবৃতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের স্মরণ করা উচিত সাকা এবং মুজাহিদ কী অপরাধ করেছে। তারা নিশ্চয়ই মোটা অংকের কিছু পেয়ে গেছে, এ জন্য এসব মন্তব্য করেছে। জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়টি আদালতে প্রক্রিয়াধীন। আদালতের বিষয়। আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন।

বিএনপি ও জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে কাউকে না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত থেকে যারা আমার দলে আসতে চায়, তাদের আমরা নেব না। তিনি বলেন, আমি পরিষ্কারভাবে বলছি, গ্রুপিংয়ে দল ভারী করতে অনেকে ভিন্ন দল থেকে যোগদান করান। তারা (যোগদানকারী) আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে অন্তঃদ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা করে। এসব লোক আমাদের দরকার নেই।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দুই পাশে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম প্রমুখ।

সফরের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রশংসা করেছেন এবং এ খাতে সহযোগিতার কথা বলেছেন। নেদারল্যান্ডসের রানী এ মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সফর করবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস উভয়ই ‘ব’-দ্বীপ রাষ্ট্র। নেদারল্যান্ডস ‘ব’-দ্বীপ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসরমান দেশ। নেদারল্যান্ডসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ বাস্তবায়নের জন্য একটি ডেল্টা কমিশন ফান্ড গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করছি।

সর্বশেষ খবর