সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
চাঞ্চল্যকর দুই শিশু খুনের দ্রুত রায়

রাজনের চার হত্যাকারীর ফাঁসি, ছয়জনের জেল

শাহ দিদার আলম নবেল, সিলেট

রাজনের চার হত্যাকারীর ফাঁসি, ছয়জনের জেল

রায় ঘোষণার পর গতকাল আদালত প্রাঙ্গণে সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজনের স্বজনরা আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন - বাংলাদেশ প্রতিদিন.

সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলায় চারজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া আদালত একজনকে যাবজ্জীবন, পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও তিনজনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। গতকাল সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ থানার শেখপাড়ার মৃত আবদুল মালেকের ছেলে কামরুল ইসলাম, সুলতান মিয়ার ছেলে তাজউদ্দিন আহমদ বাদল, পীরপুর গ্রামের মৃত মব উল্লাহর ছেলে সাদিক আহমদ ময়না ওরফে বড় ময়না ওরফে ময়না চৌকিদার ও সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ঘাগটিয়া গ্রামের অলিউর রহমানের ছেলে জাকির হোসেন পাভেল ওরফে রাজু। এর মধ্যে পাভেল পলাতক রয়েছেন। ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত চারজনকে অন্য একটি ধারায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাসের সাজার আদেশ দেন আদালত। এদিকে আলোচিত এ হত্যা মামলায় সিলেট সদর উপজেলার পূর্ব জাঙ্গাইল গ্রামের মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের ছেলে ভিডিওচিত্র ধারণকারী নূর আহমদ ওরফে নূর মিয়াকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা কামরুল ইসলামের তিন ভাই আলী হায়দার ওরফে আলী, মুহিত আলম ও শামীম আলমকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাত বছর সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে শামীম আলম পলাতক রয়েছেন। মামলায় এক বছর করে সাজা ও এক হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরগাঁওয়ের মুজতবা আলীর ছেলে আয়াজ আলী ও সিলেট সদর উপজেলার শেখপাড়া গ্রামের মৃত আলাউদ্দিন আহমদের ছেলে দুলাল আহমদের। আর বেকসুর খালাস পেয়েছেন ফিরোজ আলী, আজমত উল্লাহ ও রুহুল আমিন। বেলা সোয়া ১১টায় প্রিজন ভ্যানে করে রাজন হত্যা মামলায় কারান্তরীণ ১১ আসামিকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। সাড়ে ১১টা থেকে বিচারক আকবর হোসেন মৃধা রায় পড়ে শোনানো শুরু করেন। ৭৬ পৃষ্ঠার দুই হাজার ৮১০ লাইনের রায়ের মধ্যে শেষের ২২ পৃষ্ঠা পড়ে শোনান বিচারক। বেলা পৌনে ১টায় শেষ হয় রায় পড়া। বিচার শুরুর মাত্র ১৭ কার্যদিবসের মধ্যে ঘোষণা হয় চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার রায়। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট মফুর আলী, মশরুর আহমদ চৌধুরী শওকত, নিজাম উদ্দিন, ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী ও আব্বাস উদ্দিন। অন্যদিকে আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান হাবিব, আশরাফুল ইসলাম ও আলী হায়দার। পিপি মফুর আলী রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘রাজন হত্যা সারা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল খুনিদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। রায়ের মাধ্যমে মানুষের সে প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট।’ রায়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান ও আশরাফুল ইসলাম অসন্তোষ প্রকাশ না করলেও উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন। তারা বলেন, ‘মামলার রায় নিয়ে যে কোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা আসামিদের পক্ষে উচ্চ আদালতে যাব।’

দ্রুত ফাঁসি কার্যকর চান রাজনের মা-বাবা : ছেলে হত্যার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাজনের বাবা আজিজুর রহমান ও মা লুবনা বেগম। রায় ঘোষণার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের তারা বলেন, ‘আমাদের ছেলেকে আর ফিরে পাব না এ কথা সত্য। মামলার রায়ে যাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে, তাদের মৃত্যুদণ্ড হলে ভবিষ্যতে হয়তো এ রকম নির্মমভাবে কোনো মা-বাবার বুক খালি হবে না। কম সময়ে মামলার রায় হওয়ায় আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সারা দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এখন আমাদের একটাই দাবি, দ্রুততম সময়ে যেন রায় কার্যকর করা হয়।’

কান্নায় ভেঙে পড়লেন কামরুল, ময়না, বাদল ও নূর : রায় শুনে কাঠগড়ায় কান্নায় ভেঙে পড়লেন ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কামরুল ইসলাম, সাদিক আহমদ ময়না ওরফে ময়না চৌকিদার, তাজউদ্দিন আহমদ বাদল ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত নূর আহমদ ওরফে নূর মিয়া। ফাঁসির রায় শোনার পর কামরুল জড়িয়ে ধরেন নূর মিয়াকে। তখন কান্নারত নূর মিয়া বলতে থাকেন, ‘কেন যে ভিডিও করলাম, ভিডিও করে আজ ফেঁসে গেছি আমি।’

ফাঁসি ফাঁসি স্লোগানে প্রকম্পিত : শিশু রাজন হত্যা মামলার রায় শোনার জন্য গতকাল সকাল ৯টা থেকে সিলেট জজকোর্ট প্রাঙ্গণে লোকজনের ভিড় বাড়তে শুরু করে। বেলা সোয়া ১১টায় যখন মামলার কারান্তরীণ আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে আদালত চত্বরে নিয়ে আসা হয়, তখন চারদিক থেকে স্লোগান ওঠে ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’। প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে মামলার প্রধান আসামি কামরুলসহ অন্যদের কাঠগড়ায় নিয়ে যাওয়ার পথে উপস্থিত লোকজন পথ রোধ করে দাঁড়ান। তারা খুনিদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করেন এবং ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দেন। পরে কড়া পুলিশ প্রহরায় আসামিদের নিয়ে যাওয়া হয় কাঠগড়ায়। বেলা সোয়া ১টায় আসামিদের আদালত থেকে বের করে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময়ও উপস্থিত লোকজন ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দেন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ সময় ‘ফাঁসি, ফাঁসি’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে আদালতপাড়া।

জ্ঞান হারালেন ময়নার মা : ছেলেকে নিজ হাতে পুলিশে তুলে দিয়েছিলেন ময়না চৌকিদারের মা ছমিরন বিবি। গতকাল আদালতে এসেছিলেন ছেলের রায় শুনতে। মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে একটি নারকেল গাছের নিচে বসে ছিলেন তিনি। রায় ঘোষণার পর খবর পান ময়নার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারান তিনি।

মামলার আদ্যোপান্ত : ৮ জুলাই সিলেট নগরীর কুমারগাঁওয়ে চোর অপবাদ দিয়ে শেখপাড়া গ্রামের আজিজুর রহমানের ছেলে শিশু সামিউল আলম রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে খুন করা হয়। পরে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে মাইক্রোবাসে নিয়ে যাওয়ার পথে আটক হন মুহিত। এ সময় পালিয়ে যান ময়না চৌকিদার। এ দুজনকে আসামি করে ওই রাতে জালালাবাদ থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। পরদিন রাজনের বাবা আজিজুর রহমান সম্পূরক এজাহার দাখিল করেন। ওই এজাহারে কামরুল ও তার ভাই আলী হায়দারকে আসামি করা হয়। রাজন হত্যাকাণ্ডের পর দায়িত্বে অবহেলা ও কর্তব্যে গাফিলতির দায়ে জালালাবাদ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয় ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন, মামলার বাদী এসআই আমিনুল ইসলাম এবং এসআই জাকির হোসেনকে। পরে বিভাগীয় তদন্ত শেষে এ তিনজনকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ১৪ জুলাই মামলাটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে স্থানান্তর করা হয়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার। ১৬ আগস্ট ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন সুরঞ্জিত। আদালত ২৪ আগস্ট চার্জশিট আমলে নেন।

চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়া হয় গ্রেফতার মুহিত আলমের স্ত্রী লিপি বেগম ও শ্যালক ইসমাইল হোসেন আবলুছকে। ২৫ আগস্ট আদালতের নির্দেশে পলাতক কামরুল ও শামীমের মালামাল ক্রোক করে পুলিশ। ৩১ আগস্ট কামরুল, শামীম আহমদ ও পাভেলকে পলাতক দেখিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন আদালত। ৭ সেপ্টেম্বর মামলাটি মহানগর হাকিম আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে মামলার অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ১ অক্টোবর রাজনের বাবা আজিজুর রহমান ও মা লুবনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ। ১৮ অক্টোবর তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য গ্রহণের মাধ্যমে শেষ হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। মামলায় মোট ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ১৫ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি কামরুলকে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে কামরুল সাক্ষীদের পুনরায় জেরার আবেদন জানান। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ অক্টোবর ১১ সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করা হয়। ২৫ অক্টোবর রাজন হত্যা মামলার আসামি যাচাই-বাছাই শেষ হয় এবং যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত চলে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। পরদিন আদালত রায়ের তারিখ ৮ নভেম্বর ধার্য করেন।

ফিরে দেখা হত্যাকাণ্ড : চলতি বছরের ৮ জুলাই। সিলেট শহরতলির কুমারগাঁওয়ে ভ্যানগাড়ি চুরির অপবাদ দিয়ে খুঁটিতে বাঁধা হয় রাজনকে। এরপর শুরু হয় নির্যাতন। একটানা ১৬ মিনিট নির্যাতনের পর মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রাজন। আকুতি জানায় পানি খাওয়ার। তখন নির্যাতনকারীরা বলে, ‘পানি নাই, ঘাম খা।’ নির্যাতনের সময় রাজন যখন চিৎকার করে কাঁদছিল, তখন ঘাতকরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। রাজনের নখে, মাথা ও পেটে রোল দিয়ে আঘাত করে একসময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতে থাকে। ঘাতকদের করা ২৮ মিনিটের ভিডিওচিত্রে নির্যাতনের এমন বর্বর দৃশ্য উঠে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আপলোড করা এ ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ১৬ মিনিট নির্যাতনের পর রাজন নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর কয়েক মিনিটের জন্য তার হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয়। তখন একজন বলে ওঠে, ‘ওর হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, ওকে আরও মার।’ এরপর রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে আরেক দফা পেটানো হয়। নির্যাতনের সময় ভিডিওচিত্র ধারণকারীকে ঘাতকরা জিজ্ঞেস করে, ঠিকমতো ভিডিও হচ্ছে কি না। ওপাশ থেকে ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব’ বলতেও শোনা যায়। ভিডিওচিত্রের শেষ দিকে নির্যাতনকারী অপর একজনের কাছে জানতে চায়, ‘কিতা করতাম?’ তখন তাকে ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’ বলতে শোনা যায়। পরে এই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রাজনকে খুনের পর লাশ গুমের উদ্দেশ্যে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ঘটনাস্থলের কিছু দূর যাওয়ার পরই মাইক্রোবাসটি বিকল হয়ে পড়ে। তখন আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে ময়না চৌকিদার দৌড়ে পালিয়ে যান। মাইক্রোবাসের ভিতর শিশুর লাশ দেখতে পেয়ে গাড়িতে থাকা মুহিতকে আটক করে পুলিশে দেন জনতা।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর