সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রাকিব হত্যায় ফাঁসি দুই জনের, একজন খালাস

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা

রাকিব হত্যায় ফাঁসি দুই জনের, একজন খালাস

রায় ঘোষণার পর গতকাল আদালত প্রাঙ্গণে খুলনায় রাকিব হাওলাদারের স্বজনরা আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন - বাংলাদেশ প্রতিদিন.

খুলনার চাঞ্চল্যকর শিশু রাকিব হত্যা মামলার রায়ে তিন আসামির মধ্যে ওমর শরিফ ও মিন্টু খানকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অপর আসামি শরিফের মা বিউটি বেগমকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়েছে। গতকাল বেলা পৌনে ১টায় খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিলরুবা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন। ৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের সারাংশটুকু বিচারক আদালতে পড়ে শোনান। সারাংশে বলা হয়, আসামি শরিফ ও মিন্টুর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করা হলো। অপর আসামি বিউটি বেগমের বিরুদ্ধে আনা দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হলো। বিচারক এ রায়ের বিরুদ্ধে আগামী সাত দিনের মধ্যে আসামি পক্ষকে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথাও উল্লেখ করেন। এই সময়ের মধ্যে আপিল না করলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। রায় ঘোষণার পর কাঠগড়ায় উপস্থিত আসামিরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রসঙ্গত, শিশু রাকিব হত্যা মামলা রায় মাত্র তিন মাস পাঁচ দিনের মধ্যে ১১ বিচারিক কার্যদিবসে ঘোষণা করা হলো, যা বিচারব্যবস্থায় একটি দৃষ্টান্ত বলে আইনজীবীরা মন্তব্য করেছেন। এ রায় ঘিরে আদালত চত্বরসহ আশপাশ এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তাকে আদালত চত্বরে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। এদিকে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ওমর শরিফের মা বিউটি বেগম খালাস পাওয়ায় আদালত চত্বরে উপস্থিত রাকিবের স্বজন ও এলাকাবাসী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তারা আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ির গতি রোধ করে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। রায় শুনে রাকিবের বাবা নূরে আলম কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, ‘শরিফের মা বিউটি বেগমের কারণেই আমার রাকিবকে হারিয়েছি। কিন্তু সে খালাস পেয়ে গেল।’ রায় ঘোষণার পর আদালত চত্বরে থাকা রাকিবের মা ও বোনকে অচেতন হয়ে পড়তে দেখা যায়। মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে যে আসামি খালাস পেয়েছেন তার বিষয়ে রায়ের মূল কপি হাতে পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’ ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মিন্টু খানের আইনজীবী তৌহিদুজ্জামান তৌহিদ বলেন, এ রায়টি আবেগতাড়িত রায়। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। ওমর শরিফ ও তার মা বিউটি বেগমের আইনজীবী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।’ জানা যায়, মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ ছেড়ে দেওয়ার কারণে ৩ আগস্ট বিকালে খুলনা নগরীর টুটপাড়া কবরখানার মোড়ে শরিফ মোটর্সের ভিতর মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়ার কম্প্রেশার মেশিন দিয়ে শিশু রাকিবের পায়ুপথে হাওয়া ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। স্থানীয়রা ঘটনায় জড়িত অভিযোগে শরিফ ও মিন্টু মিয়াকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে শরিফের মা বিউটি বেগমকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পরদিন নিহত রাকিবের বাবা মো. নূর আলম বাদী হয়ে তিনজনকে আসামি করে খুলনা সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। ২৫ আগস্ট এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক কাজী মোস্তাক আহমেদ এজাহারভুক্ত তিন আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। ১১ অক্টোবর বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। আদালত এ মামলার চার্জশিটভুক্ত ৪০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। ১ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে রায়ের দিন ধার্য করা হয়।

মাত্র ১১ কার্যদিবসে রায় : শিশু রাকিব হত্যা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে দাখিলের পর মাত্র ১১ বিচারিক কার্যদিবসে গতকাল রায় ঘোষিত হয়েছে। আর এটিকে বিচারব্যবস্থায় একটি দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্পর্শকাতর এ মামলাটি দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি হওয়াটা বিচারব্যবস্থায় একটি উদাহরণ, যা অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। একই সঙ্গে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাকে আরও মজবুত করবে।

‘যে বিউটি বুক খালি করল হে খালাশ পাইলো ক্যামনে’ : ঘড়ির কাঁটা দুপুর পৌনে ১টা। জনাকীর্ণ আদালতে রাকিব হত্যা মামলার রায় পড়ে শোনাচ্ছেন বিচারক দিলরুবা সুলতানা। বাইরে তখন বিপুলসংখ্যক মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। রায়ে তিন আসামির মধ্যে শরিফ ও মিন্টুর ফাঁসি আর অপর আসামি শরিফের মা বিউটি বেগমকে খালাস দেন বিচারক। এ রায় শোনার পরপর অপেক্ষমাণরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাদের বিক্ষোভের কারণ বিউটি বেগমের খালাস পাওয়া। অল্প সময়ের মধ্যেই আদালত চত্বরে বিক্ষোভকারীদের ভিড় বেড়ে যায়। শুরু হয় স্লোগানসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন। কিছু বিক্ষোভকারী আদালতের সামনের সড়কে মিছিল শুরু করেন। পুলিশ কড়া পাহারায় আসামিদের নিয়ে কারাগারে রওনা হলে প্রিজন ভ্যান আটকে দেন বিক্ষোভকারীরা। প্রিজন ভ্যানটি ঘিরে ধরে আসামিদের প্রতি ঘৃণা-ক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। রাকিবের নিকটাত্নীয়সহ এলাকাবাসীর অনেকেই চিৎকার করে রায়ের প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদ জানাতে জানাতে কয়েক দফা জ্ঞান হারান রাকিবের মা লাকী বেগম। তিনি প্রলাপ বকতে বকতে বলেন, ‘আমারে সরকারের কাছে নিয়া যাইতে পারবেন? আমি হ্যাগোরে জিগাইতে চাই, যে বিউটি আমার বুক খালি করছে, হে খালাস পাইলো ক্যামনে? বিউটির কথামতো শরিফ ও মিন্টু আমার পোলাডারে মারছে। তাগো যদি ফাঁসি হয়, তয় বিউটির খালাস মানি না।’

সর্বশেষ খবর