রাজা-উজিরের যুগ শেষ হয়ে গেলেও ভূমি অফিসের এক নাজিরের ক্ষমতা এখনো কমেনি। সেটা টের পাওয়া যায় রাজধানীর নর্দায় অবস্থিত গুলশান এসিল্যান্ড অফিসে গেলে। সেখানে একজন নাজিরের দৌরাত্নরে কাছে সবাই অসহায়। ফাইল (নথি) গুনে গুনে ঘুষ আদায় করেন তিনি। চাহিদার কানাকড়ি কম হলেও ফাইল ছাড়েন না। এভাবে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা পকেটে পুরে তিনি বাসায় ফেরেন। ভুক্তভোগী, সেবাপ্রার্থী ও নাজিরের সহকর্মীরা এসব তথ্য জানান। গুলশান এসিল্যান্ড অফিসে কথা হয় ভাটারার হাজী মকবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি মিস কেসের নিষ্পত্তি হতে এক বছর পেরিয়ে গেছে। নাজির মিজানুর রহমানের চাহিদা মতো এক লাখ টাকা ঘুষ দিতে পারিনি বলে মাসের পর মাস ঘুরে জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলেছি। কিন্তু কেসের কোনো গতি হচ্ছে না। এখন আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, কাক্সিক্ষত ঘুষ না দিলে আমার বিপক্ষে রায় হবে। আমার মতো আরও অনেকের অবস্থা একই রকম। নাজিরের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগের মধ্যে গুরুতর হলো, জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে জমির নামজারি করিয়ে দেওয়া। এ ধরনের প্রতিটি নামজারি করতে মিজান দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নেন। তিনি সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করে দীর্ঘদিন এ ধরনের জালিয়াতি করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, কালাচাঁদপুরের সানাউল্লাহ নামের একজন প্রতারককে জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে জমির নামজারি করিয়ে দেন নাজির মিজান। ওই নামজারির কাগজ দিয়ে সানাউল্লাহ ব্যাংক থেকে কয়েক কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। সূত্র জানায়, গুলশান এসিল্যান্ড অফিসে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদ কব্জা করে নিয়েছেন নাজির মিজান। তিনি একই সঙ্গে নাজির-কাম-ক্যাশিয়ার, মিস কেস সহকারী ও নামজারি সহকারী। অথচ সেখানে কয়েকজন সার্ভেয়ার ও কানুনগো আছেন। সাধারণ নিয়ম হলো, অফিস সহকারীরা নাজির হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে সার্ভেয়াররা মিস কেস সহকারীর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অভিযোগ আছে, এসিল্যান্ড অফিসের লোভনীয় তিনটি পদ একাই দখল করে মূলত ঘুষের রাজত্ব কায়েম করেছেন মিজান। অনুসন্ধানে জানা যায়, গুলশান রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (এসি) ল্যান্ড মোসাদ্দেক মেহেদী ইমাম ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সৎ। ভূমি মালিকদের কাছে তিনি একজন আদর্শস্থানীয় কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কানাকড়িও ঘুষ খান না তিনি। তার এ সততাকে পুঁজি করে নাজির মিজান সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। গুলশানের সেবাপ্রত্যাশী হবিবুর রহমান জানান, একটি প্লট নিয়ে নামজারির রায় দেওয়ার কথা বলে এসিল্যান্ডের নাম করে তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন নাজির-কাম-মিস কেস সহকারী মিজান। পরে জানা যায়, এসিল্যান্ড একজন সৎ কর্মকর্তা। তিনি কারও কাছ থেকে এক টাকাও উৎকোচ নেন না। এ কথা শোনার পর মিজানকে আর ঘুষ দেওয়া হয়নি। এ কারণে মামলা দীর্ঘায়িত করে একের পর এক তারিখ দেওয়া হচ্ছে। জানা যায়, গুলশান এসিল্যান্ড অফিসে বর্তমানে কয়েকশ মিস কেস চলমান। মিস কেস সহকারী হিসেবে কেসের প্রতিটি ফাইল সংরক্ষিত থাকে মিজানের কাছে। এ সুযোগে কেসের ফাইল থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ সরিয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নর্দার স্থায়ী বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, আমার একটি মিস কেস দীর্ঘ দেড় বছর ধরে চলছে। মামলার রায় আমার পক্ষে দেওয়ার কথা বলে মিস কেস সহকারী মিজান দুই লাখ টাকা দাবি করেন। তা না দেওয়ায় তিনি কেসের ফাইল থেকে আমার কয়েকটি মূল্যবান কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দেন। এ কারণে জমির প্রকৃত মালিক হওয়া সত্তে¡ও আমি সে মামলায় হেরে যাই। এমন আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে কালাচাঁদপুরের বাসিন্দা নুরুল ইসলামের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ওয়ারিশদের মধ্যে একটি মিস কেস দাখিল হওয়ার পর মিজান একটার পর একটা তারিখ দিয়ে আমাকে অযথা হয়রানি করছেন। অথচ সব রকম তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, ওই জমি আমার পরিবারের। তা সত্তে¡ও মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে জালিয়াতচক্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন মিজান। এর আগে মিজান ওই জালিয়াতের নামে আমার মালিকানাধীন সম্পত্তি নামজারি করিয়ে দেন। এ ব্যাপারে মিস কেস করলে অন্যায়ভাবে আমার মামলাটি নথিজাত করা হয়। আমি বর্তমানে ওই মিস কেসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছি এডিসি রেভিনিউয়ের কাছে। জানা গেছে, গুলশান এসিল্যান্ড অফিসে প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার নামজারি হয়। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি নামজারি থেকে নাজির মিজান ঘুষ আদায় করে থাকেন। সাধারণ একটি নামজারি থেকে তিনি ৫০০ থেকে এক হাজার এবং জটিল নামজারি থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি বছরে নামজারি খাত থেকেই ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ আদায় করে থাকেন। তার চাহিদা মতো ঘুষ না দিলে তিনি নানা কৌশলে সে নামজারি নামঞ্জুর করান। আবার ঘুষ দিলে তা মঞ্জুর হয়ে যায়। সরেজমিন দেখা যায়, মিজান নামজারির সরকারি ফি সাড়ে ১১ টাকা আদায় করেন ডুপ্লিকেট কার্বন কপির (ডিসিআর) মাধ্যমে। কিন্তু এর বাইরে তিনি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে নেন ভূমি মালিকদের কাছ থেকে। ওই টাকা না পেলে তিনি ডিসিআর দিতে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে থাকেন। আবার ঘুষ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ডিসিআর দিয়ে দেন। এভাবে বছরে ১২ হাজার নামজারির ডিসিআর খাত থেকে মিজান কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা ঘুষ আদায় করেন বলে একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ থেকে জানা যায়। সূত্র জানায়, মিজানের ঘুষের সবচেয়ে বড় খাত হলো মিস কেস। প্রতি বছর ওই অফিসে প্রায় ৩০০ মিস কেস দায়ের হয়। অফিসের একটি সূত্রে জানায়, এমন কোনো মিস কেস নেই, যা থেকে মিজান ঘুষ আদায় করেন না। এভাবে শুধু মিস কেস থেকে তিনি ঘুষ আদায় করেন বছরে ২০ লাখ টাকা।

নাজির মিজানের কক্ষেই কথা হয় মিস কেসের এক বাদীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, মিজান টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। কেউ ঘুষ না দিলে তার হয়রানির শেষ নেই। ঘুষ পেলে তিনি রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানিয়ে ফেলেন। গুলশান এসিল্যান্ড অফিসের একাধিক কর্মচারী জানান, মিজানের দাপটের কাছে পুরো অফিস জিম্মি। ১০ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী হয়েও তিনি ২০ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন খিলগাঁওয়ে। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তার আÍীয় বলে তিনি কাউকে তোয়াক্কা করেন না। ঢাকা জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আÍীয় পরিচয় দিয়ে মিজান তার দফতরকে ঘুষের রাজত্বে পরিণত করেছেন। ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। সেই আÍীয়র প্রভাবে মিজান বিভিন্ন লোভনীয় জায়গায় বদলি হয়ে থাকেন বলেও জানা যায়। রমনা, ধানমন্ডির পর গুলশানে তিনি নাজির ও নামজারি সহকারী হিসেবে চাকরি করে বর্তমানে কোটিপতি। গুলশান এসিল্যান্ড অফিসের আওতায় রয়েছে গুলশান, ডুমনী ও গোবিন্দপুর তহশিল অফিস। এসব অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাজির মিজানের দাপটে রীতিমতো তটস্থ থাকেন। এসব অফিসের একাধিক কর্মচারী জানান, মিজান শুধু সাধারণ ভূমি মালিকদেরই নয়, তহশিল অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও নানাভাবে হয়রানি করেন। মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়া তিনি কোনো ফাইল ছাড়েন না। এসিল্যান্ডের সততাকে পুঁজি করে নাজির একাই পুরো অফিসকে ঘুষের আখড়া বানিয়েছেন। তৃতীয় শ্রেণির পদে চাকরি করলেও পোশাক ও চলাফেরায় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদেরও হার মানান মিজান। কথায় কথায় দম্ভোক্তি করে বলেন, কেউ তার ঘুষ-দুর্নীতির বিচার করতে পারবে না। কারণ, তিনি একাই সে ঘুষ খান না, ঊর্ধ্বতন মহলকেও ভাগ দেন। নাজির মিজানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এসিল্যান্ড মোসাদ্দেক মেহেদী ইমাম বলেন, আমি সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে অফিস পরিচালনার চেষ্টা করছি। আমার অজান্তে কোনো কর্মচারী ঘুষ নেওয়া কিংবা হয়রানির সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনেক সময় সঠিক সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা চাই। ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, ভূমি প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। ঘুষ-দুর্নীতি-হয়রানি করার জন্য অভিযুক্ত নাজির মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অবশ্যই তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাজির মিজান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এ সম্পর্কে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।