মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চলছেই ধরপাকড়

সাখাওয়াত কাওসার ও মাহমুদ আজহার

চলছেই ধরপাকড়

নাশকতার পৃথক মামলায় নিম্ন আদালতে হাজিরা দিতে গেলে সম্প্রতি জেলে পাঠানো হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে। একইভাবে জেলে পাঠানো হয় যশোর জেলা বিএনপির সহসভাপতি রফিকুর রহমান তোতন, সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, সদস্য অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, নগর সভাপতি মারুফুল ইসলামসহ ৬ জনকে। ওই মামলার আসামি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামকেও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় জয়পুরহাট জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মতিউর রহমান ও নোয়াখালী যুবদলের সভাপতি ভিপি জসিম উদ্দিনকে। বিএনপি দাবি করছে, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু করে টানা ৫ দিনের অভিযানে ২০-দলীয় জোটের অন্তত ৫ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে বিএনপিরই প্রায় ২ হাজার নেতা-কর্মী বলে দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, নিরীহ জনগণকে জিম্মি করে ব্যাপক বাণিজ্যে নেমেছে পুলিশ।

এদিকে, সারা দেশ থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী গতকাল ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের গ্রেফতার হওয়া নেতা-কর্মী অন্তত ৬৪৪ জন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ এ অভিযান চলবে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, চলতি মাসেই বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহ্সান মোহাম্মদ মুজাহিদের রায়, আগামী ডিসেম্বরে পৌর ও মার্চে ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে দুর্বৃত্তদের তৎপর হওয়ার আশঙ্কা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চলবে। অভিযানে পুলিশকে সহায়তা করবে র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড। তবে বিশেষ নজর থাকবে ঝুঁকিপূর্ণ ২৩টি জেলায়। এসব জেলায়ও গত বছর তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। তবে বাণিজ্য হচ্ছে এমন অভিযোগ সত্য নয়। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালের শেষের দিকে দেশের বিভিন্ন জেলায় হত্যা, অগ্নিসংযোগসহ তাণ্ডবলীলার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর অভিযোগপত্রে নাম আসা আসামিদের গ্রেফতার এবং যারা আবার নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে মূলত তাদের গ্রেফতারেই এই অভিযান। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে  বলেন, সিভিল প্রশাসন বিশেষ করে সরকার যতদিন চাইবে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে বিজিবি সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন। তবে বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব জেলায় বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ওই জেলার প্রতি বিশেষ নজর থাকবে। যৌথ অভিযানে পুলিশই সমন্বয় করছে বলে জানান তিনি। বিএনপির নীতি নির্ধারকরা বলছেন, আসন্ন পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে বিএনপি জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের খড়গ নেমে আসছে। সম্ভাব্য জনপ্রিয় প্রার্থীরা যাতে নিজ নিজ এলাকায় না থাকতে পারেন, সেজন্যই দেশজুড়ে চলছে ধরপাকড়। নেতাদের না পেলে কর্মী-সমর্থক কিংবা পরিবারের সদস্যদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। তা ছাড়া বিএনপিকে সুসংগঠিত হতে দিতে চায় না সরকার। দেশজুড়ে চলা পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতেই এ ধরনের অভিযান চালানো হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা উপলক্ষে নেতা-কর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাধা দিতে চায় সরকার। তাই ধরপাকড়ের পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায়কে ঘিরে সরকার গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে বলেও বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করেন। গণগ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘গত কয়েক দিনে বিএনপির দুই হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক মন্ত্রী বলেছেন, ‘ক্রিমিনালদের ধরা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ক্রিমিনাল বলে গণ্য করা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। এ ধরনের মনোভাব উগ্র ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। বিরোধী দলকে নিঃশেষ করার যে অশুভ প্রক্রিয়া সরকার গ্রহণ করেছে, তা গণতন্ত্রকে আরও বিপন্ন করে তুলবে। বিরোধী মত সরকার একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। তাই দেশ এখন রাজনীতিশূন্য হয়ে পড়ছে।’ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা যাতে অংশ না নিতে পারেন, সেজন্য সারা দেশে গণগ্রেফতার চলছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত।’ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহ্মুদ খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার স্বার্থেই মূলত পুলিশ, বিজিবি এবং এলিট ফোর্স র‌্যাব অভিযান চালাচ্ছে। সাধারণ ও নিরীহ কোনো মানুষ যাতে ধরপাকড়ের শিকার না হয় এ ব্যাপারে র‌্যাব সদস্যরা সচেতন রয়েছেন। জনগণের জান-মালের সুরক্ষার স্বার্থে এবং নাশকতা চালাতে পারে এমন যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই এ অভিযান।

নিরাপত্তা নিশ্চিতের তাগিদ আইজিপির : পুলিশ সদস্যদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের ওপর দুর্বৃত্তদের একের পর এক হামলায় পুলিশ বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিশেষ করে আশুলিয়ার ঘটনাটি তুলে ধরেন আইজিপি। ভবিষ্যতেও দুর্বৃত্তরা আবার পুলিশের ওপর হামলা চালাতে পারে, এ জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অনুষ্ঠিত গতকালের বৈঠকে।

সূত্র জানায়, আইজিপি মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছেন, বিভিন্ন চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সদস্যরা যেন অবশ্যই তাদের অস্ত্রে গোলাবারুদ ভর্তি রাখে, লেগ গার্ড ব্যবহার ও সেফটি হেলমেট ব্যবহার করেন। নিজেরাই যেন নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। কেউ হামলা চালাতে এলে সঙ্গে সঙ্গে যেন পুলিশ প্রতিরোধ করে। তবে হিংসার বশবর্তী হয়ে কেউ যেন কোনো নিরীহ মানুষের ওপর চড়াও না হন। এ বিষয়েও সতর্ক থাকার কথা বলেন আইজিপি।

বিশেষ বৈঠকে র‌্যাবসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন ডিএমপির প্রায় সবকটি থানার ওসিও। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আইজিপির সামনে তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন বৈঠকে।

আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, রবিবার রাত থেকে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলার  ২০ দলের ১২২ জনকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে দিনাজপুর সদর উপজেলায় ২২ জন, বীরগঞ্জ উপজেলায় ৭ জন, কাহারোল উপজেলায় ৬ জন, বিরল উপজেলায় ৬ জন ও চিরিরবন্দর উপজেলায় ১১ জন। দিনাজপুর পুলিশ সুপার রুহুল আমিন জানান, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে নাশকতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এবং সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও চলমান বিভিন্ন মামলার কিছু ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিও রয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর জানান, জেলায় বিএনপি ও জামায়াতের দুই কর্মীসহ ৫৯ জনকে আটক করেছে পুলিশ। রবিবার রাতে জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। লক্ষীপুর প্রতিনিধি জানান, লক্ষীপুরে পুলিশের বিশেষ অভিযানে বিএনপি-জামায়াতের ২৫ নেতা-কর্মীসহ ৫৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, মহানগরীতে পুলিশের রাতভর অভিযানে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ১৬ নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছে। নগরীর ৪ থানা পুলিশ রবিবার রাতভর অভিযান চালিয়ে এই ১৬ জনসহ বিভিন্ন মামলার আসামি ৪৯ জনকে গ্রেফতার করেছে।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, নাশকতার অভিযোগে বিজিবি, র‌্যাব, কোস্টগার্ড ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানে জামায়াত-শিবিরের ৩০ কর্মীসহ ৪৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রবিবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত জেলার আটটি থানায় এই অভিযান পরিচালনা করা হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলার পাঁচ উপজেলায় রবিবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিএনপি ও জামায়াত কর্মীসহ ৪১ জনকে আটক করেছে পুলিশ।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলায় র‌্যাব-পুলিশ ও বিজিবির যৌথ অভিযানে জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ও জামায়াত-বিএনপির ২৯ নেতা-কর্মীসহ ৩৯ জনকে আটক করা হয়েছে। রবিবার রাত ১০টা থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত সদর, বেলকুচি ও উল্লাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান,  জেলায় পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া নাশকতা মামলায় জামায়াতের এক কর্মীসহ ২১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, জেলায় জামায়াত-শিবিরের ১৭ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্যে সদর উপজেলার ৩ জন, শৈলকুপা থেকে ১ জন, কালীগঞ্জ থেকে ৪ জন, কোটচাঁদপুর থেকে ৩ জন ও মহেশপুর থেকে ৬ জনকে আটক করা হয়েছে।

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নাশকতা প্রতিরোধে শহরে রাতভর যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে একজন আইনজীবী ও জামায়াত-শিবিরের  নেতা-কর্মীসহ ১০ জনকে আটক করেছে। তন্মধ্যে শহরের ঈদগাহ এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা  থেকে ৬টি ককটেলসহ  সৈয়দ হাফিজুল ইসলাম নামে এক যুবককে আটক করা হয়।

সাভার প্রতিনিধি জানান, ধামরাইয়ে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে বিএনপির ৯ নেতা-কর্মীকে দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল ভোররাতে ধামরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান, জেলা আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে গ্রেফতার হয়েছেন ছাত্রদলের দুই নেতা। গতকাল নগরীর তালতলা থেকে তাদের গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাদের কোতোয়ালি থানায় হস্তান্তর করা হয়।

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, জঙ্গি তৎপরতা ও নাশকতার আশঙ্কায় ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে দৈনিক সংগ্রামের পীরগঞ্জ প্রতিনিধি ও উপজেলা জামায়াতের সাবেক প্রচার সম্পাদক হাফিজুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রবিবার গভীর রাতে তার নিজ বাড়ির সামনে থেকে তাকে আটক করা হয়। নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, যৌথবাহিনীর অভিযানে যুবদলের সভাপতি ভিপি জসিম উদ্দিনসহ বিএনপি-জামায়াতের ৯৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, রবিবার মধ্যরাত থেকে গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে জামায়াতের ৬ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, পুলিশ অভিযান চালিয়ে এক জামায়াত নেতাসহ ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর