মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রাজনের গ্রামে আনন্দ কামরুলের ঘরে তালা

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

রাজনের গ্রামে আনন্দ কামরুলের ঘরে তালা

বর্বরোচিত নির্যাতনে নিহত শিশু রাজনের মামলায় কামরুলসহ চারজনের ফাঁসির আদেশে খুশি সিলেটের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। মামলার রায়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাজনের বাবা আজিজুর রহমান ও মা লুবনা বেগম। রায়ে উচ্ছ্বসিত রাজনের গ্রামের মানুষও। ফাঁসির রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত রাজনের পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন তারা। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কামরুল ইসলামের ঘরে ঝুলছে তালা। কামরুলের ফাঁসির আদেশের খবরে তার নিজ গ্রামের মানুষ খুশি হলেও তা প্রকাশ করতে পারছেন না অজানা আতঙ্কে। হত্যাকাণ্ডের পর যে আতঙ্ক ঘিরে ধরেছিল শেখপাড়া গ্রামবাসীকে, রায়ের পরও কাটেনি তা। গতকাল সকালে রাজনের গ্রামের বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেয়ালিতে গিয়ে দেখা যায়, রাজনের বাবা শুয়ে আছেন বিছানায়। রায় নিয়ে গত কয়েক দিনের টেনশন ও দৌড়াদৌড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। গ্রামের লোকজন এসে খোঁজখবর নিচ্ছেন তার। পুত্রহারা আজিজুর রহমানকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে খুনিদের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা। সাহস জুগিয়ে চেষ্টা করছেন তার মনোবল চাঙা করার। রাজনের প্রতিবেশী সালাম মিয়া জানান, রায় শোনার জন্য রবিবার গ্রামের অনেকেই আদালতে গিয়েছিলেন। খুনিদের ফাঁসির আদেশ হওয়ায় গ্রামবাসী মিলে উল্লাস করেছেন। রাতেই গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনকে যেভাবে খুন করা হয়েছে, তা মধ্যযুগীয় নির্যাতনকেও হার মানায়। খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতে এলাকার লোকজন ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছেন। হত্যাপরবর্তী সময় এলাকার লোকজন রাজনের পরিবারের পাশে ছিলেন। খুনিরা যাতে উচ্চ আদালত থেকে রেহাই না পায় সে জন্য যা করণীয় রাজনের পরিবারের পাশে থেকে এলাকার লোকজন তা করবেন। রাজন হত্যার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে স্থানীয় ইউপি সদস্য জহির আহমদ বলেন, ‘এখন আমরা খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর দেখতে চাই। এ জন্য রাজনের পরিবারকে এলাকার পক্ষ থেকে সাধ্যমতো সব সহযোগিতা করা হবে।’

শয্যাশায়ী রাজনের বাবা আজিজুর রহমান মামলার রায়ে খুশি হলেও তা কার্যকর নিয়ে তার শঙ্কা কাটছে না। তিনি বলেন, ‘খুনিরা প্রভাবশালী। তাদের অনেক টাকা-পয়সা আছে। উচ্চ আদালত থেকে তারা যদি কোনোভাবে শাস্তি মওকুফ পেয়ে বের হয়ে আসতে পারে, তাহলে ছেলের মতো আমার পরিবারের সবাইকে প্রাণ হারাতে হবে।’ তারা আমাদের ছেড়ে দেবে না। খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি মিলবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে রবিবার সকালে সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নের শেখপাড়ায় কামরুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পিনপতন নীরবতা। ঘরের দরজায় ঝুলছে তালা। পুরো বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নি কাউকে। বাড়ি থেকে বের হয়ে কথা হয় গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কেউ নিজের নাম-ঠিকানা বলতে রাজি হননি। যাদের সঙ্গেই কথা হয়েছে তাদের মুখে দেখা গেছে আতঙ্কের ছাপ। আতঙ্ক নিয়েই কয়েকজন জানালেন, রাজন হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই গ্রামের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কোনো বিষয়ে মুখ খুললেই প্রভাবশালী কামরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে নির্যাতন নেমে আসতে পারে। অন্যদিকে পুলিশ মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে পারে এমন আতঙ্কও ছিল গ্রামজুড়ে। তাই হত্যার ঘটনায় মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ থাকলেও এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। একইভাবে রায়ের পর গ্রামের লোকজন উচ্ছ্বসিত হলেও ভয়ে তা প্রকাশ করতে পারেননি। প্রসঙ্গত, ৮ জুলাই কুমারগাঁওয়ে চোর অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে খুন করা হয় শিশু রাজনকে। রবিবার সিলেট মহানগর দায়রা জজ আকবর হোসেন মৃধা এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। হত্যার ঘটনায় শেখপাড়া গ্রামের কামরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমদ বাদল, পীরপুর গ্রামের সাদিক আহমদ ময়না ওরফে ময়না চৌকিদার ও সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ঘাগটিয়া গ্রামের জাকির হোসেন পাভেলের ফাঁসির আদেশ হয়। এ ছাড়া কামরুলের ভাই মুহিত আলম, আলী হায়দার ও শামীম আলমকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত। ওই মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে আরও তিনজনকে সাজা দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর