বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
জানাজায় মানুষের ঢল

চিরনিদ্রায় শায়িত ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক

চিরনিদ্রায় শায়িত ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান

ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমানের জানাজায় গতকাল মুসল্লিদের ঢল -বাংলাদেশ প্রতিদিন

লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ আলেম ও বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার (মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বাংলাদেশ  বসুন্ধরা ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা) উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ মুরব্বি, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান। এ আলেমে দীনের শেষ ইচ্ছানুসারে গতকাল বেলা পৌনে ১২টায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এন ব্লকে বসুন্ধরা নতুন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার-৫-এর সামনে মুফতি আবদুর রহমানের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় দেশের শীর্ষ আলেম-ওলামাদের উপস্থিতিতে লাখো মুসল্লির ঢল নামে। জানাজা নামাজ পরিচালনা করেন মুফতি আবদুর রহমানের বড় ছেলে মুফতি আরশাদ রাহমানি। উল্লেখ্য, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মুফতি আবদুর রহমান। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তার ইন্তেকালের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের নানা প্রান্তের বাংলাদেশিসহ সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। জানাজাপূর্ব বক্তব্যে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান মুফতি আবদুর রহমানের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বলেন, ইসলামের প্রচার-প্রসারে তার অসাধারণ ভূমিকা ছিল। ইসলামী গবেষক হিসেবে তিনি কাজ করে গেছেন। তার অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহান, বসুন্ধরা গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাফওয়ান সোবহান, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজামসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। জানাজার আগে দেশের বিশিষ্ট আলেমরাও মুফতি আবদুর রহমানের কর্মবহুল জীবন নিয়ে কথা বলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিরপুর আরজাবাদ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মোস্তফা আজাদ, যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও মজলিসে দাওয়াতুল হকের আমির মাওলানা মাহমুদুল হাসান, সাবেক এমপি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাহী সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাস, ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুফতি রুহুল আমিন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নতুন মহাসচিব মওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, খেলাফতে ইসলামের নেতা মাওলানা আবুল হাসনাত আমিনী, জমিয়ত নেতা মওলানা জুনাইদ আল হাবিব, শায়খ জাকারিয়া, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ, মাওলানা শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, আমি তার কাছে গেলে আলাদা প্রশান্তি অনুভব করতাম। এই অগণিত মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে, তিনি মানুষের কত প্রিয় এবং কত ভালো মানুষ ছিলেন।

মুফতি আবদুর রহমানের নামাজে জানাজা ও দাফনে যোগ দিতে সকাল থেকেই দলে দলে অগণিত মানুষ এসে জড়ো হতে থাকেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। বসুন্ধরা বড় মাদ্রাসা বা বসুন্ধরা কেন্দ্রীয় মসজিদ বলে খ্যাত ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমানের জানাজার কথা থাকলেও লোকসমাগমের ঢল দেখে কর্তৃপক্ষ বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার-৫-এর সামনের রাস্তায় নামাজে জানাজার ব্যবস্থা করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইকও প্রস্তুত করা হয়। জানাজার আগে মুফতি আবদুর রহমানের লাশ হিমায়িত গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। কিন্তু এখানে তারা দাঁড়িয়ে ছিলেন সারিবদ্ধভাবে। উদাস দৃষ্টি ঝাপসা করে দেওয়া চোখের পানিসমেত। মাইকের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। ক্ষণে ক্ষণে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, ইনশা আল্লাহ! সকাল ১০টায়ই জানাজা শুরু হবে। ঘোষণা শুনে আরও নীরব হয়ে যায় বিশাল জনসমুদ্র। ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমানের জানাজার পরিবেশ ছিল এমনই। লোকসমাগমের আধিক্যে রাস্তার চিত্রটা ছিল অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন। সকাল সোয়া ৭টা। ঢাকার প্রবেশদ্বার টঙ্গী বাজার বাস স্টেশন। টঙ্গী থেকে খিলক্ষেত-বসুন্ধরা হয়ে যে গাড়িগুলো নিয়মিত চলাচল করে তার কোনোটাতেই ওঠার উপায় নেই। অফিসগামী মানুষের সঙ্গে টুপি-পাঞ্জাবি পরা যাত্রীর ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। না বললেও বোঝা যায়, তাদের গন্তব্য বসুন্ধরা।

টঙ্গী হয়ে আবদুল্লাহপুর, হাউস বিল্ডিং, আজমপুর, রাজলক্ষী, জসীমউদ্দীন, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত প্রতিটি বাস স্টেশন হয়ে উঠেছিল লোকে লোকারণ্য। ঠিক একই চিত্র মিরপুর থেকে কুড়িল উড়ালসড়ক হয়ে ও রামপুরা দিয়ে বসুন্ধরা আসার রাস্তার। একই চিত্র ছিল পল্টন, মালিবাগ, রামপুরা হয়ে আসার রাস্তার। সাতসকালে রাস্তায় বের হওয়া এই বিপুল জনতার গন্তব্যও যে মুফতি আবদুর রহমানকে শেষ বিদায় জানানো, তা ততক্ষণে নগরবাসী বুঝে গেছে। গতকাল রাজধানীর সব পথ গিয়ে যেন মিলে গিয়েছিল বসুন্ধরা এলাকায়। কফিনবাহী গাড়িটি আসার আগেই জানাজাস্থলে আলেম-উলামা ছাড়াও নানা পেশার লাখো মানুষের ভিড় জমতে শুরু করে। অশীতিপর প্রবীণ থেকে শুরু করে বাবার হাত ধরে আসা স্কুলপড়ুয়া শিশুটি- কে ছিল না! সবার বেদনামাখা মুখ। শোকে বিহŸল সবাই। প্রিয় এই আলেমের জানাজায় অংশ নিতে দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন তারা।

সংগত কারণে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রবেশের সব রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। অত সকালে বসুন্ধরার আশপাশের অফিসগুলো ব্যস্ত হয়নি। দোকানিরা তাদের পসরা তখনো সাজাননি। সাধারণত বসুন্ধরা এলাকার লোকজন মানুষের ভিড়ভাট্টা দেখতে খুব একটা অভ্যস্ত নয়। তারাও এই সকালে আগত মানুষের অজুর ব্যবস্থা, অপরিচিতকে রাস্তা বলে দেওয়ার কাজ করেছেন নিজ উদ্যোগে। মুফতি আবদুর রহমানের জানাজায় আগত মুসল্লিরা বলাবলি করছেন, বিশাল উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে, নানা কর্মযজ্ঞ ও জ্ঞান সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের বিশ্বাসী মুসলমান ও উলামায়ে কেরামের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। আমরা মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে কামনা করি, তিনি যেন পরকালেও আল্লাহতালার এমন ভালোবাসা লাভ করেন। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। এদিকে দেশবরেণ্য এ শীর্ষ আলেমে দীনের সম্মানে গতকাল ঢাকার সব মাদ্রাসার ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়। মাদ্রাসাগুলোতে তার জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। ব্যবস্থা করা হয় পবিত্র কোরআন খতমেরও।

মুফতি আবদুর রহমান ১৯২৫ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ইমামনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম চান মিয়া। তিনি নাজিরহাট ও হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক লেখাপড়া সমাপ্ত করেন। উচ্চমাধ্যামিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে গমন করেন। ১৯৫০ সালে সেখানে কওমি মাদ্রাসা পাঠক্রমের সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের ইফতা বিভাগের তিনি প্রথম ডিগ্রি লাভকারী মুফতি।

ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর চরমোনাই, কওমী রকিত ফেডারেশনের মহাসচিব এম এ আউয়াল, মঞ্চের চেয়ারম্যান মুফতি মোহাম্মদ তাসনীম, খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুফতি রুহুল আমিন, হাফেজ মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক।

সর্বশেষ খবর