শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মা-বাবা খুনে ঐশীর ফাঁসি

আদালত প্রতিবেদক

মা-বাবা খুনে ঐশীর ফাঁসি

পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে তাদের মেয়ে ঐশী রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের পর ঐশীকে আশ্রয় দেওয়ায় তার বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ঐশীর আরেক বন্ধু আসাদুজ্জামান জনিকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার পর কান্নায় ভেঙে পড়া ঐশী তার আইনজীবীদের আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন। ঐশীর চাচা ও নিহত পুলিশ কর্মকর্তার ছোট ভাইয়ের দাবি, ‘ঐশীকে ফাঁসানো হয়েছে। তার বন্ধুরাই প্রকৃত খুনি।’ জানা যায়, ২০১৩ সালে মেয়ের হাতে বাবা-মা খুনের রায় ঘিরে আদালতপাড়ার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সামনে গতকাল সকাল থেকে ছিল উৎসুক আইনজীবী ও মানুষের ভিড়। বেলা ১১টার দিকে ঐশীকে আদালতে নেওয়া হয়। এ সময় মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে থাকলেও বেশ স্বাভাবিক ছিলেন ঐশী। তাকে ঘিরে রেখেছিলেন ৩ জন নারী পুলিশ। আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন কারাগারে আটক থাকা রনি ও জামিনে থাকা জনি। তিন আসামির উপস্থিতিতে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিচারক সাঈদ আহমেদ রায় পড়া শুরু করেন। মামলার রায় অনুসারে, বাবা ও মায়ের জোড়া খুনের জন্য ঐশী রহমানকে আলাদা আলাদা করে দুবার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। প্রত্যেক মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর অন্যটি সরাসরি বাতিল হয়ে যাবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক সাঈদ আহমেদ বলেন, ‘ঘটনার দিন ঐশী নেশাগ্রস্ত ছিল। তার ক্রিমিনাল ইনটেন্ট (অপরাধ সংঘটনের ইচ্ছা) ছিল। হঠাৎ করেই কোনো উত্তেজনা ছিল না, পূর্বপরিকল্পিতভাবে সে তার বাবা-মাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। সে সুকৌশলে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে।’ ঐশীর মামলার ক্ষেত্রে তার বয়স নিয়ে একটি বিতর্ক উত্থাপিত হওয়া প্রসঙ্গে বিচারক বলেন, ‘যেখানে শিশু ও নারী নির‌্যাতন দমনের পক্ষে আমাকে রায় দিতে হয় সেখানে উল্টো রথে এসে আজ এই মামলায় আমাকে রায় দিতে হচ্ছে। এটা আমার জন্য কঠিন। আমি বয়সের চিন্তা করেছি এবং তার (ঐশীর) প্রকৃত বয়স পেয়ে গেছি। ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুসারেই তার বয়স ধরা হয়েছে। আমার পর্যবেক্ষণে, ঘটনার সময় সে সাবালক হিসেবে এসেছে। রাষ্ট্রপক্ষ ঐশীর প্রকৃত বয়স প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আর সে যে সাবালিকা, এটাও প্রমাণ হয়েছে। আসামিপক্ষ ঐশীর বয়সের পক্ষে যা যুক্তি দিয়েছে, তা যথাযথ নয়’ বলে মন্তব্য করেন আদালত। রায় ঘোষণার পর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি ঐশী। কান্নায় ভেঙে পড়ে। উপস্থিত নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের তার চোখের পানি মুছে দিতে দেখা যায়। অঝোরে এই কান্নার মধ্যেই তার সঙ্গে কথা বলেন আইনজীবীরা। আপিল করার কথা বলেন ঐশী। এরপরই তাকে আদালত থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান জানান, হত্যাকাণ্ডের পর ঐশী আশ্রয় নিয়েছিলেন বন্ধু রনির বাসায়। অপরাধীকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে দুই বছরের সাজা হয়েছে তার। তবে গ্রেফতার হওয়ার পর রনি ইতিমধ্যে ১৯ মাস হাজতে কাটিয়েছেন।

সুতরাং তার দুই বছরের সাজা থেকে ওই সময় বাদ যাবে বলে আদালত রায়ে জানিয়েছেন।

ঐশীর রায় মেনে নিতে পারছে না পরিবার : ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, ঐশীর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার মরাগাংকান্দা গ্রামে। সেখানে থাকা তার পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় মেনে নিতে পারছেন না।  রায়ের পর স্থানীয় সাংবাদিকদের ঐশীর চাচা ও মামলার বাদী মশিউর রহমান বলেন , এ রায় আমরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছি না। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। উচ্চ আদালতে আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। তিনি আরও জানান, এ আদেশের পরপরই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন ঐশীর দাদি মুকছেদা খাতুন (৭০)।

গৃহকর্মী সুমির বিরুদ্ধে মামলা শেষ হয়নি : জোড়া খুনের মামলায় ঐশীকে সহযোগিতার অভিযোগে তাদের বাসার গৃহকর্মী সুমির মামলার বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। গৃহকর্মী খাদিজা আক্তার সুমি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার বিচার চলছে শিশু আদালতে।

তদন্ত চলাকালে হাকিম আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ড ও পরে লাশ সরানোর ক্ষেত্রে ঐশীর কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছে ১১ বছর বয়সী এই বালিকা। গত বছরের ২০ মে অভিযোগ গঠন করে তাকে জামিন দেন শিশু আদালতের বিচারক জাকিয়া পারভিন। পরে গত বছরের ১ জুন গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্র থেকে মা সালমা বেগমের জিম্মায় জামিনে মুক্তি পায় সে।

 

জানা যায়, স্ত্রী, দুই সন্তান এবং শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে থাকতেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট ওই বাসা থেকেই তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, লাশ উদ্ধারের আগের রাতে কোনো এক সময় কফির সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করেন ঐশী। পরদিন সকালে সাত বছর বয়সী ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে যান। পরে ভাইকে এক প্রতিবেশীর বাসায় পাঠিয়ে একদিন পর গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে রমনা থানায় আÍসমর্পণ করেন ঐশী। পরে তার বক্তব্যের সূত্র ধরেই রনি ও জনিকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ সবাইকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে। রিমান্ডের পর ঐশী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও পরে তা অস্বীকার করে বলেন, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল। আদালতে তিনি দাবি করেন, বাবা-মা যখন খুন হন তখন তিনি বাসায় ছিলেন না; কারা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাও তিনি জানেন না। অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘ও’  লেভেলের শিক্ষার্থী ঐশীর বয়স বিদ্যালয়ের নথি অনুযায়ী ১৮ বছরের কম হওয়ায় তাকে রিমান্ডে  নেওয়ার মাধ্যমে শিশু আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে সে সময়। বয়সের সমর্থনে খুলনার একটি ক্লিনিকের জম্ন সনদও আদালতে দাখিল করেন ঐশীর আইনজীবী। পরে আদালতের নির্দেশে গত বছর ২০ আগস্ট ঐশীকে পরীক্ষা করে ঢাকা  মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, এই কিশোরীর বয়স ১৯ বছরের মতো। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আবুল খায়ের মাতুব্বর আদালতে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। তাতে বলা হয়, বাবা-মাকে ঐশীই হত্যা করেন; আর অন্যরা তাকে সহযোগিতা করেন। মহানগর দায়রা জজ আদালত গত বছরের ৬ মে ঐশীসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগ গঠন করেন। পরে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে গেলে গত বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ বি এম সাজেদুর রহমান আবারও অভিযোগ গঠন করে ঐশীদের বিচার শুরু করেন। বাদীপক্ষে ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ঐশীর চাচাসহ ৩৯ জনের জবানবন্দি  শোনেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে বিশেষ প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান এবং আসামিপক্ষে  ফারুক আহমেদ ও মাহবুবুর রহমান রানা গত ২০ অক্টোবর ও ৪ নভেম্বর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। গত ৪ নভেম্বর মামলার সর্বশেষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য গতকাল দিন ধার্য করেছিলেন আদালত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর