শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নূর হোসেনে অপার রহস্য

রিমান্ড চাওয়া হয়নি । পাঠানো হয়েছে কারাগারে । ইঙ্গিত নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক বিরোধের

সাখাওয়াত কাওসার, রোমান চৌধুরী ও এম এ শাহীন, নারায়ণগঞ্জ থেকে

নূর হোসেনে অপার রহস্য

র‌্যাব সদর দফতর থেকে গতকাল নূর হোসেনকে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জে - বাংলাদেশ প্রতিদিন

অপার রহস্যে ঘেরা বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার অন্যতম প্রধান আসামি নূর হোসেন। বন্দী বিনিময় চুক্তির পর ভারত থেকে নিয়ে আসার পরও চাঞ্চল্যকর মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামিকে রিমান্ডে না নেওয়ায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। মামলার বাদীপক্ষ ও আইনজীবীরা আদালত চত্বরে গণমাধ্যমের কাছে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, অতি গুরুত্বপূর্ণ এই আসামিকে কমপক্ষে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্যোগ নিতে পারত পুলিশ। অন্যদিকে, গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১১ মামলায় নূর হোসেনকে গ্রেফতার (শ্যোন অ্যারেস্ট) দেখিয়ে হাজির করানো হলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।  এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ২০ মিনিটে বেনাপোল সীমান্তে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নূর হোসেনকে গ্রহণের পর র‌্যাব-১ কার‌্যালয় হয়ে সকাল সোয়া ৮টায় নারায়ণগঞ্জ আনা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় নারায়ণগঞ্জ আদালতপাড়াসহ আশপাশ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নূর হোসেনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে নারায়ণগঞ্জের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ এবং নানা কাহিনী প্রকাশ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র আরও জানায়, সীমান্তে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে আদালতে হাজির করার আগ পর্যন্ত নূর হোসেন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সাত খুনের ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করে নেন। দেশে ফিরতে পেরে যথেষ্ট উচ্ছাসিত নূর। কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে নূর হোসেন নারায়ণগঞ্জ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ রুটে তার যাত্রীবাহী বাস লাইন ‘এবিএস পরিবহন’ হাইকোর্টের মাধ্যমে বন্ধ করা, তার নিজের দখলে থাকা বালুমহাল হাতছাড়া হওয়ার নেপথ্যে থাকা মানুষদের দিকে ইঙ্গিত করেন। তবে সাত খুনের ঘটনা থেকে তার পলায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ড ও তার কর্মকাণ্ডের চিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরায় রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যান নূর হোসেন। সহজ স্বীকারোক্তি দিয়ে তিনি বারবার বলতে থাকেন ‘স্যার আপনারা তো সবই জানেন। তয়, আমি আর কী কমু! আমার জায়গা দখল কইরা যারা এখন আছে তারা কি ভালো মানুষ?’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, নারায়ণগঞ্জের দুই আওয়ামী লীগ নেতা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনের দ্বন্দ্বই ছিল হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ। একই ধারার রাজনীতি করলেও ব্যবসায়িক স্বার্থ, এলাকায় প্রভাব বিস্তার এবং রাজনৈতিক অবস্থানগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ওই দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিনের শত্র“তা ও পাল্টাপাল্টি মামলা ছিল।

রিমান্ড না চাওয়ায় ক্ষোভ : গতকাল নূর হোসেনের সঙ্গে এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। তিনি জানান, আমাদের দাবি ছিল নূর হোসেনকে আবারও নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করে চার্জশিট দেওয়া হোক। তাহলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু নূরের চেহারা দেখে আমাদের ভয় কাজ করছে। কারণ নূরকে আদালতে নেওয়া-আনার সময়ে হাসতে দেখা গেছে। রিমান্ড আবেদন না করায় আমরা ক্ষুব্ধ। অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছেন, পুলিশ এর আগে বলেছিল, নূর হোসেনের জন্য তারা অপেক্ষা করছে। নূর হোসেন দেশে ফিরলেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করবে। কিন্তু পুলিশ নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। মামলার বাদী নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি আদালতে চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিল করেছিলেন। কিন্তু আদালত তার নারাজি খারিজ করে দিয়েছেন। আমরা এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে যাব। নূর হোসেন আলোচিত সাত খুনের পরিকল্পনাকারী ও অর্থ জোগানদাতা। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি নূর হোসেনকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে হলেও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। তাহলে সাত খুনের রহস্য উম্নোচিত হবে। বাংলাদেশে এমন অনেক মামলার নজির রয়েছে যেগুলো আদালতে সাক্ষ্য শুরু হওয়ার পরও পুনঃ তদন্ত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জেই এমন নজির রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ১৬ জুন চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা মামলার ক্ষেত্রেই আদালতে সাক্ষী শুরু হওয়ার পর মামলাটি আবারও পুনঃ তদন্তের দিকে গেছে।

কেন্দ্রীয় কারাগারে : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নূর হোসেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। তিনি সুস্থ আছেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে তাকে কোথায় রাখা হয়েছে তা আপাতত প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে সূত্র নিশ্চিত করেছে নূরকে ‘শাপলা’ সেলে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তার আশপাশে আর কোনো বন্দী রাখা হয়নি।

এর আগে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার হালিমা খাতুন জানান, সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ মামলা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক আসামিকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সে হিসেবেই বিকাল ৪টায় নূর হোসেনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আদালতপাড়ায় প্রস্তুতি : দুপুরে নূর হোসেনকে আদালতে উঠানো হলেও সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ আদালতপাড়ায় ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আদালতপাড়ায় প্রবেশের মূল ফটকে ছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সংবাদকর্মী ও প্রশাসনের লোকজন ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

আদালতে শুনানি : বেলা আড়াইটায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সহিদুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। ওই সময়ে ১১টি মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয় তাকে। শুনানি শেষে নূর হোসেনকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন আদালত।

রিমান্ডে নেওয়া প্রসঙ্গ : নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন বলেছেন, সাত খুনের দুটি মামলাতেই গ্রেফতারকৃত ২১ আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ১৪ জন সাক্ষী স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলার ওয়ারেন্ট আছে। যার মধ্যে ১১টি মামলা সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ও দুটি ফতুল্লা মডেল থানায়। ১০টি জিআর মামলা, দুটি সিআর মামলা ও একটি কনভিকশন হয়েছে। ওই ১৩টি মামলায়ই নূর হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মামলায় নূর হোসেনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। যেহেতু নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলায়ই আদালত থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে সেহেতু তাকে রিমান্ড চাওয়ার সুযোগ নেই। 

অন্যদিকে পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, আদালতে ১১টি মামলায় নূর হোসেনকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। যেহেতু মামলাগুলোর ইতিমধ্যে চার্জ গঠন হয়ে গেছে সেহেতু রিমান্ড আবেদন করা যায়নি। যে ১১টি মামলায় নূর হোসেনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে সেগুলো হলো - আলোচিত সাত খুনের দুটি মামলা ৭৪(৪)১৪, ১১(৫)১৪, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মামলা ২১(৬)১৪, ১০(৪)১৪, ৪০(৫)১৪, ৪৫(৫)১৪, ১৫(৫)১৪, ৩(৮)১৫, ৪২(৫)১৪, সিআর মামলা ৬৯৯/১৪ ও ৪৮৯/১৪। এই ১১টি মামলার সবকটিরই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

জুতা নিক্ষেপেও হাস্যোজ্জ্বল : নূর হোসেনের ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ আর স্লোগানে উত্তাল ছিল নারায়ণগঞ্জ আদালত চত্বর। ব্যাপক পুলিশি নিরাপত্তায় নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইনস থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় নূর হোসেনের গাড়ি লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করলেও পুরো সময়ই হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেছে তাকে। এ সময় নূর হোসেনের পরনে ছিল খাকি রঙের প্যান্ট ও সাদা কালো স্ট্রাইপের গেঞ্জি। বাম হাতে ছিল নীল রঙের একটি ঘড়ি।

তার পক্ষে ছিলেন না কোনো আইনজীবী : শুক্রবার আদালতে শুনানির সময় নূর হোসেনের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির মামলার আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান, মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি খোকন সাহাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোড থেকে নাসিক কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করে র‌্যাব-১১ এর একটি দল। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল ছয়জন ও  ১ মে একজনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার তদন্ত শেষে র‌্যাব-১১ এর সাবেক তিন কর্মকর্তা ও নূর হোসেনসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা জেলা ডিবি পুলিশ। এর মধ্যে ২২ জন গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দী রয়েছেন। আর নূর হোসেনসহ ১৩ জন পলাতক ছিলেন। তবে নূর হোসেন গত বছরের ১৩ জুন ভারতে গ্রেফতার হয়ে ওই দেশের কারাগারে বন্দী ছিলেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর