রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শঙ্কামুক্ত নয় বাংলাদেশও

জটিল হবে বিশ্ব পরিস্থিতি, ভাঙতে পারে ইইউ, বাড়বে সহিংসতা

জুলকার নাইন ও জিন্নাতুন নূর

ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশও ঝুঁকিমুক্ত নয়। হয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই বড় মাপের হামলার ঝুঁকি নেই, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও এ ধরনের ন্যক্কারজনক হামলার শঙ্কা রয়েছে। আইএস বা আল-কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সরাসরি বাংলাদেশে কার্যক্রম না থাকলেও দেশের অভ্যন্তরে থাকা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ক্ষুদ্র পরিসরে তাদের আক্রমণ চালিয়েই যাচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা নিরীহ মানুষকে। তাই সতর্ক হতে হবে বাংলাদেশকেও। ফ্রান্সে হামলার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেছেন সামরিক বিষয়াদির বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা-বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, প্যারিস হামলা বিশ্ব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে। বাড়বে সহিংসতা। সেই সঙ্গে অভিবাসী ইস্যুতে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে ইইউকে। অভিবাসী ও নিরাপত্তা ইস্যুতে ইইউ আর একসঙ্গে সীমান্তবিহীন অবস্থায় থাকবে কি না সে বিতর্ক চূড়ান্ত পরিণতি পেতে পারে। ফ্রান্সে ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা কোনোভাবেই অপ্রত্যাশিত নয় বলে মনে করেন নিরাপত্তা-বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার। তিনি বলেন, ফ্রান্স আইএসবিরোধী যুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধে আইএস ও ফ্রান্স সরাসরি দুই পক্ষ হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে। তাই যুদ্ধ চলাকালে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর আক্রমণ বা হামলা চালাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই ফ্রান্সে হামলার ঘটনাকে অপ্রত্যাশিত বলা যাবে না। তিনি বলেন, আইএসের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের যেসব দেশ মিসাইল হামলা চালাচ্ছে, অর্থ জোগান দিচ্ছে, এর মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। তারই পাল্টা আক্রমণ হিসেবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে এ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার একটি প্রধান লক্ষ্য থাকে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করা। তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে সারা বিশ্বকে বার্তা দেওয়া। যেমন এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের মতো একযোগে ছয়টি দেশে বোমা হামলা করার ক্ষমতাও তাদের আছে, তা দেখিয়ে দেওয়া হলো। সুতরাং ফ্রান্স তাদের টার্গেটই ছিল। তবে শুধু ফ্রান্স নয়, পুরো পশ্চিমা বিশ্বকেই ই হামলার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হলো অন্যদের ওপরও আক্রমণ হতে পারে। বাংলাদেশে এ ধরনের বড় মাপের সন্ত্রাসী হামলার শঙ্কা এ মুহূর্তে দেখছেন না সামরিক বাহিনীর সাবেক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার। তিনি বলেন, আইএসের প্রথম টার্গেট হলো, বিশ্বের যেসব দেশ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং অর্থ জোগান দিচ্ছে, এ তালিকায় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশও রয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাদের টার্গেটে রয়েছে শিয়াপ্রধান দেশগুলো। যেমন পাকিস্তানে তারা নানা ধরনের হামলা চালাচ্ছে। এ দুই হিসেবেই বাংলাদেশ টার্গেটের মধ্যে নেই। কারণ যুদ্ধকালে এক ধরনের টার্গেটেই আক্রমণ বা হামলা চালানো হয়। একসঙ্গে নানা ধরনের টার্গেট নেওয়া হয় না। তবে বাংলাদেশ পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ছোট সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো, যেমন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা জেএমবির মতো সংগঠনগুলো এখানে সোচ্চার রয়েছে। তাদের এ মুহূর্তে বড় মাপের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ‘ডিফেন্সলেস মানুষ’কে তারা টার্গেট করছে। এ দেশের মুক্তবুদ্ধি চর্চা করা, লেখালেখি করা, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কথা বলা মানুষগুলোকে তারা টার্গেট করছে। তাই বাংলাদেশের এ মুহূর্তের কর্তব্য এই নিরীহ মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্যারিসে হামলার মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্যারিসে দুঃখজনক হামলার শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষ। কোনো সন্দেহ নেই যে এ হামলা আইএস চালিয়েছে। যাদের এ হামলা চালানোর জন্য পাঠানো হয়েছে তারাও যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এদের কমান্ডো স্টাইলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ১০ থেকে ১৫ জন লোক এ হামলা চালিয়েছে। এর আগেও ফ্রান্সের একটি ম্যাগাজিন অফিসে উগ্রবাদীরা হামলা চালিয়েছে। কিন্তু সেটি এত বড় ধরনের হামলা ছিল না। সাবেক সামরিক এ কর্মকর্তা বলেন, ‘প্যারিসের ভিতরে মেশিনগানসহ অন্যান্য গান নিয়ে যাওয়া দুরূহ ব্যাপার। আর প্যারিস ফ্রান্সের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে। আমার ধারণা, সেখানে কিছু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক আশপাশের দেশগুলো থেকে অস্ত্র জোগাড় করে এ হামলা চালিয়েছে। কাজেই এ হামলার মধ্য দিয়ে তারা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তারা বিশ্ববাসীকে জানাল, নিজ দেশের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন দেশেও তারা সন্ত্রাসী হামলা চালাতে সক্ষম। আর এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই কঠিন। ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দেশেও এদের ঠেকানো যায় না। এখন চিন্তার বিষয় এই যে, এদের ঠেকানো যায় কীভাবে।’ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এত দিন ধরে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বর্ডার খোলা ছিল, তা এখন সাময়িকভাবে আর খোলা রইল না। এরই মধ্যে হল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও বেলজিয়ামে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এ ঘটনার পর এই দেশগুলো আর কত দিন “বর্ডারলেস” রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্যও নতুন প্রশ্ন। একই সঙ্গে অভিবাসী ইস্যুতে ইইউ কী করবে তাও নতুন করে ভাবতে হবে। এ অবস্থায় আমি আশঙ্কা করছি, বিশ্বব্যাপী সহিংসতা আরও বাড়বে। বিশেষ করে সিরিয়া, আমেরিকা ও রাশিয়া সব দেশ মিলে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবে।’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ফ্রান্সে হামলার ঘটনার প্রভাব অবশ্যই বাংলাদেশে পড়বে বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে আর্থিক সহায়তার বিষয়ে প্রভাব পড়বেই। এ কথা কেউ মানুক আর না মানুক। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ব্লগারদের ওপর হামলা, বিদেশি হত্যা, এসব ঘটনাই বাংলাদেশে বড় ধরনের জঙ্গি হামলার প্রাথমিক ধাপ। এসব ঘটনাই বড় ধরনের কোনো হামলার পূর্ববর্তী লক্ষণ। বাংলাদেশ ফ্রান্সের চেয়ে অনেক ছোট একটি রাষ্ট্র। কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা যেসব আলামত দেখেছি, তা জঙ্গি উত্থানের জন্য যথেষ্ট। যেহেতু আমাদের জাতীয় কোনো ঐক্য নেই, সে কারণে কোনো হামলা হলে তা সামাল দিতে পারব কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিহিংসা অনেক। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদের। আমরা যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে আছি। রাজনৈতিক দলগুলোর এখন গালাগালি করার সময় নয়। আমাদের বুঝতে হবে বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ছোট মুসলমান রাষ্ট্র। আর এখানে জঙ্গিদের নজরও বেশি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর