সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ফ্রান্সে হামলার ঘোষণা হয় ১৫ দিন আগেই

শওগাত আলী সাগর, টরেন্টো থেকে

ফ্রান্সে হামলার ঘোষণা হয় ১৫ দিন আগেই

মুসলিম চরমপন্থি সংগঠন ইসলামিক স্টেট যখন তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকদের বিরুদ্ধে সুবিধাজনক স্থানে হামলা চালানোর আহ্বান সংবলিত ভিডিও বার্তাটি প্রকাশ করে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া তখন নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়- বাংলাদেশেই তাদের নাগরিকরা জঙ্গিদের হামলার শিকার হবে। সেই ‘ধরে নেওয়াটার’ ভিত্তি কী ছিল তা তারা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেনি।  কিন্তু  বাংলাদেশের ওপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় বইয়ে দিয়েছে তারা। ‘গোয়েন্দা সূত্রের খবরের’ বরাত দিয়ে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে ক্রিকেট টিম পাঠানো বন্ধ করে দেয়, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বাংলাদেশে তাদের নাগরিকদের জন্য বিশেষ সতর্কতা জারি করে একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলে। ইসলামিক স্টেটের ভিডিও বার্তাটিতে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ ছিল না। তবু সেই বার্তাটিকেই পশ্চিমা দেশগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে এবং বিশ্বাস করেছে। কিন্তু ইসলামিক স্টেটের পূর্বসূরি আল কায়েদা যখন সুনির্দিষ্টভাবে ফ্রান্সে হামলা করার জন্য অনুসারীদের আহ্বান জানিয়ে অডিও বার্তা প্রকাশ করে, তখন সেটিকে কোনো পশ্চিমা দেশই আমলে নেয়নি। এমন কি ফ্রান্সও না। অথচ সেই বার্তাটি প্রকাশের পনেরো দিনেরও কম সময়ে প্যারিসে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং প্রায় দেড় শতাধিক নিরীহ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ফ্রান্সের কোন শহরে এই হামলার ঘটনা ঘটবে, সেটি ফ্রান্স নিজেও জানত। অন্তত তাদের তাদের ধারণার মধ্যে ছিল। তা সত্ত্বেও ফ্রান্স হামলা এবং প্রাণহানি ঠেকাতে পারেনি। কেন পারেনি- সেটি অবশ্য মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। ফ্রান্সে হামলার আহ্বানটি অবশ্য ইসলামিক স্টেট জানায়নি। সেটি জানিয়েছিল আল কায়েদা। মালিয়ান তোয়ারেগ লিডার অব আনসার দ্বীন-এর নেতা আয়াদ ঘালি অডিও বার্তার মাধ্যমে তার সমর্থকদের ফ্রান্সে হামলার আহ্বান জানিয়েছিল। সেই অডিও বার্তাটি প্রকাশ করেছিল ‘আল কায়েদা ইন দ্য ইসলামিক মাগরিব’ নামের একটি সংগঠন। ‘সাইট ইনটেলিজেন্স’ সেই অডিও বার্তাটিকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে তাদের ওয়েবসাইটে প্রচারও করেছিল। ওই বার্তায় সুস্পষ্টভাবেই জিহাদিদের ফ্রান্সে হামলা চালানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল। গত শুক্রবার প্যারিসে সংঘটিত পৈশাচিক ঘটনার দায় স্বীকার করে দেওয়া ইসলামিক স্টেটের বিবৃতির ভাষা আর গত ১ নভেম্বর ফ্রান্সে হামলা চালানোর আহ্বান সংবলিত বার্তাটির মধ্যে ভাষাগত তেমন একটা পার্থক্য নেই। তবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আয়াদ ঘালির ক্ষোভের কারণ সুনির্দিষ্টভাবে মালির ঘটনা। ২০১৩ সালে মালিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর সেখানে জিহাদিদের দমনে ফ্রান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখনো মালিতে ফ্রান্সের উপস্থিতি এবং প্রভাব আল কায়েদা তথা ইসলামি জঙ্গিদের কোণঠাসা করে রেখেছে। আয়াদ ঘালির বিবৃতিতেও সেই কথার উল্লেখ রয়েছে। কেবল মালিই নয়, এ মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ইসলামি চরমপন্থিদের দমনে চলমান সামরিক  অভিযানগুলোতে ফ্রান্স সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মুসলিম জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ফ্রান্সেরই ১০ হাজারের বেশি সামরিক সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। তার মধ্যে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় যথাক্রমে ৩ হাজার ২ হাজার সৈন্য রয়েছে, ইরাকে রয়েছে ৩২০০ ফরাসি সেনা সদস্য।  গত সপ্তাহেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, পারস্য সাগরে ইসলামিক স্টেটবিরোধী অভিযানে সহায়তা দিতে তার দেশ বিশেষ আকাশযান মোতায়েন করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিক অধ্যুষিত ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রান্সের ইসলামি মৌলবাদবিরোধী শক্ত অবস্থান- ইসলামি চরমপন্থিদের ক্ষুব্ধ করেছিল, এটি কোনো নতুন তথ্য নয়। কিন্তু আল কায়েদার মতো একটি চরমপন্থি গোষ্ঠীর নেতার ফ্রান্সে আক্রমণের সরাসরি আহ্বান জানানো বক্তব্য প্রচার পাওয়ার পর দেশটি এ ব্যাপারে কী সতর্কতা অবলম্বন করেছিল, তা জানার সুযোগ মনে হয় নেই। সুযোগ না থাকলেও প্যারিসে রক্তাক্ত হামলার পর এ ধরনের নানা প্রশ্ন জনমনে জাগছে। একই সঙ্গে প্রশ্নও তৈরি হচ্ছে- এর পর কি? প্যারিসে দেড় শতাধিক নিরীহ মানুষের মৃতদেহের ওপর দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন কোনো শান্তির বারতা আসবে? নাকি নতুন করে যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হবে? যেমনটি হয়েছিল ১/১১ এর টুইন টাওয়ারের হামলার ঘটনার পর। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা অবশ্য ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, প্যারিসের সহিংস ঘটনার পর বিশ্ব-রাজনীতির অগ্রাধিকার গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নেবে। সেই বাঁকটি যে আরও বেশি যুদ্ধেরই ঈঙ্গিত দিচ্ছে সেটি তাদের বিশ্লেষণ থেকে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, প্যারিসে হামলা আসলে একটি ‘যুদ্ধ’। যুদ্ধই তো বটে। গত কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে যে চিত্রটি পাওয়া যায় তাকে যুদ্ধ ছাড়া আর কিইবা বলা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি ভূখণ্ড দখল করে ইসলামিক হুকুমাত কায়েমের এক ধরনের লড়াই তারা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার বিমানে হামলা, বৈরুতের একটি শহরে বোমা হামলা এবং সর্বশেষ প্যারিসের ঘটনা- এগুলো যে ইসলামিক স্টেট পরিকল্পিতভাবে করছে তা এখন পরিষ্কার। রাশিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ব্যাপারে রাশিয়া যদিও ইসলামিক স্টেটের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করছে, তবে এটিকে তাদের কাজ বলেই সবাই বিশ্বাস করছে। ইসলামিক স্টেট পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে পশ্চিমা দেশগুলো যে বসে থাকবে- তা ভাববার কোনো কারণ নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টও খোলামেলাই বলে দিয়েছেন, তিনি ‘নির্দয়ভাবে’ জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। সেই ‘নির্দয় জবাব’টা যে তিনি একা দেবেন না- সেটাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যে কোয়ালিশনটি আছে- আগামী দিনগুলোতে সেটিকে আরও সক্রিয় করার চেষ্টা তারা অবশ্যই করবেন। মালিতে বোমা হামলার পর বলতে গেলে ফ্রান্স একাই আল কায়েদা দমনে ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু নিজ দেশে হামলার ঘটনার পর তারা যৌথভাবে মোকাবিলার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। ন্যাটোর আর্টিকেল ৫কে আলোচনায় নিয়ে আসতে চাচ্ছে ফ্রান্স। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, মিত্রদের কারও একজনের ওপর হামলা হলে এটি সবার ওপর হামলা হিসেবেই বিবেচিত হবে এবং সম্মিলিতভাবে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে। এই অনুচ্ছেদ ধরেই আফগানিস্তানে ন্যাটো সেনাবাহিনী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ করতে গিয়েছিল। ফ্রান্স এখন ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ন্যাটোকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। ন্যাটো এ ক্ষেত্রে এগিয়ে না এলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন যে এগিয়ে আসবে এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। প্যারিসের হামলার সূত্র ধরে ইসলামিক স্টেটবিরোধী স্থল হামলার সম্ভাবনাটিই এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন ইসলামিক স্টেটের অবস্থান লক্ষ্য করে বোমা যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তাতে অবশ্য তেমন একটা ফল পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি রাশিয়াও সেখানে বোমা হামলা শুরু করলে সেটি নিয়ে পশ্চিমে বেশ সমালোচনার জন্ম হয়। সিরিয়ার ক্ষমতাসীনদের সমর্থনের প্রশ্নে পশ্চিমাদের ভিন্নরকম অবস্থান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদেশগুলো সিরিয়ার ইসলামিক স্টেট নির্মূলের লড়াই করলেও তারা মূলত আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়। তাদের এই চাওয়া কোনো রাখঢাক বা গোপন ব্যাপার নয়। এ কারণেই ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু প্যারিসের ঘটনার পর পশ্চিমাদের সুরও খানিকটা বদলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ‘ইসলামিক স্টেট হচ্ছে উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।  কাজেই সিরিয়ার অন্য ইস্যুগুলোকে আলাদাভাবে ভাবতে হবে’- এ ধরনের মনোভাব তৈরি হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে।

আর সেই মনোভাব থেকেই ইসলামিক স্টেট নিধন করতে গড়ে ওঠা কোয়ালিশনের মধ্যে বিমান হামলার বদলে স্থল হামলার সম্ভাবনা নিয়েই আলোচনা শুরু হয়েছে। স্থল হামলা মানেই তো কোনো একটি দেশের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়া, কোনো একটি দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া। প্যারিস ঘটনা সম্ভবত সে রকমই একটি যুদ্ধের সূচনা করতে যাচ্ছে। লেখক : শওগাত আলী সাগর, টরন্টোর বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’ এর প্রধান সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর