শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এটাই বুঝি শেষ প্রণাম বাবা

ভারতের নতুন ঠিকানায় সাবেক ছিটের ৬৩ জন

রেজাউল করিম মানিক, লালমনিরহাট

এটাই বুঝি শেষ প্রণাম বাবা

নাগরিকত্ব নিয়ে ভারত চলে যাওয়া বাবাকে প্রণাম জানাচ্ছেন ছেলে। লালমনিরহাটের বিলুপ্ত উত্তর গোতামারী ছিটমহল থেকে তোলা ছবি :বাংলাদেশ প্রতিদিন

এটাই বুঝি জীবনের শেষ প্রণাম। মরে গেলেও আর বাবার মুখ দেখার সৌভাগ্য বুঝি হবে না। ভালো থেকো বাবা আমাদের আশীর্বাদ করিও। গতকাল সকালে হাতীবান্ধা

উপজেলার সদ্য বিলুপ্ত উত্তর গোতামারী ছিটমহলের বাসিন্দা ভৈরব চন্দ্রকে এভাবেই বিদায় জানান তার ছেলে বীরেন চন্দ্র। বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা ভৈরব চন্দ্র ভারতের নাগরিকত্ব নিতে আবেদন করেন। তিন মেয়ে আর দুই ছেলের সংসার তার। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে। আর এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন ভারতে। দুই ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভৈরব চন্দ্র সকালে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগ মুহূর্তে এ দেশে থাকা মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়স্বজন আসেন তাদের বিদায় জানাতে। এ সময় তার ছেলে বিলাপ করতে করতে বলেন, জীবনে অনেক বার বাবাকে প্রণাম করছি। কিন্তু এত কষ্ট কখনো পাইনি। এটাই বুঝি জীবনের শেষ প্রণাম। আর হয়তো কোনো দিন বাবাকে প্রণাম করতে পারব না। এদিকে, একই বিলুপ্ত ছিটের বিনয়ের ছেলে বিপুলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে কালীগঞ্জ উপজেলার চামটা এলাকার ধরনী কান্তের মেয়ে প্রিয়াংকার। স্বামী আর সন্তানের মুখ চেয়ে প্রিয় জন্মভ‚মি, বাবা-মা, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন সবকিছু ছেড়ে ভারতে গেলেন তিনি। তাকেও শেষ বিদায় জানাতে ছুটে আসেন বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। প্রিয়াংকা বলেন, স্বামী আর সন্তানের জন্য ভারতে যাচ্ছি। মরার সময়ও বাবার বাড়ির কাউকে হয়তো দেখতে পারব না। এ সময় কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পুরো উত্তর গোতামারী গ্রাম। সকালে রওনা হতে হবে বলে আগের রাতে অনেকেই রান্না করেননি। কিন্তু তাতে খাওয়া থেমে থাকেনি কারও। প্রতিবেশীরাই তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে গতকাল দুপুর ২টার দিকে প্রথম দলটি ভারত পৌঁছায়।

ভারতের নতুন ঠিকানায় সাবেক ছিটের ৬৩ জন : ‘মোর ভারত যাবার মন না চায়। স্যাটে মোক ক্যাও চিনবার পাইবে না, মুই ডোকা (কামলা) দিয়া খ্যাওন। মুই এই সোনার বাংলা ছাড়ি যাবার ন্যাং বাহে বলতে বলতে মূর্ছা যান ভারতগামী মাধবী রানী।’ গোতামারী উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সুচরিতা রানী বলেন, সে থাকতে চায়। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে তাকেও ওপারে যেতে হচ্ছে। জানি না কোনো দিন এদেশে আসতে পারব কিনা। অশ্রুসিক্ত নয়নে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন আর ৬৮ বছরের মায়ার জালে বেঁধে রাখা বাপ-দাদার জমিজমা ছেড়ে গতকাল বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন হাতীবান্ধা উপজেলার বিলুপ্ত দুটি ছিটের ৬৩ জন অধিবাসী। যেতে চায় না মন কিন্তু তবু যেতে হলো। কারণ ছিটমহল বিনিময়ের পর কে বাংলাদেশে থাকবে আর কে ভারত যাবে এ দুটি অপশন ছিল। সে মোতাবেক বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ১১১টি ছিটমহলের ৯৭৯ জন ভারতে যাওয়ার অপশন দেয়। তাদের মধ্যে প্রথম ধাপে গতকাল দুপুরে ভারতে গেলেন এই ৬৩ জন। গতকাল হাতীবান্ধার উত্তর গোতামারীর বিলুপ্ত ছিটমহলে গিয়ে দেখা যায় এক হƒদয় বিদারক দৃশ্য। দেশত্যাগীদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। আর কতদিনে দেখা হবে প্রিয়জনদের মুখ। এ বেদনা সইতে পারছে না কেউই। সূর্য উঠার পর থেকেই ছিটমহলের বাসিন্দারা যা তারা সঙ্গে নিয়ে যাবেন এমন জিনিসপত্র গোছানো শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পাঠানো গাড়িতে জিনিসপত্র তুলে নেয়। তাদের বিদায় জানাতে সকাল থেকেই ভিড় জমায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীরা। সর্বত্রই বেজে উঠে বিদায়ের সুর। একে অপরের গলা ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রথম দফায় হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার একজন নবজাতকসহ মোট ৬৩ জন ট্রাভেল পাসধারীরা গতকাল দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে বুড়িমারী স্থলবন্দর জিরো পয়েন্ট চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে চলে যান। এদের মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বী ৬১ জন ও দুই পরিবারের দুজন মুসলমান রয়েছেন। পর্যায়ক্রমে অন্য বিলুপ্ত ছিটমহলের ট্রাভেল পাসধারীরা ভারতে যাবেন। প্রথম পর্যায়ের ৬৩ জনকে ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হবে বলে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। ৬৩ জনকে কোচবিহার জেলার ডিএম ওলাথ নাথন গ্রহণ করেন আর ভারতে যাওয়ার সময় বুড়িমারী স্থলবন্দরে এ সময় বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুর কুতুবুল আলম ও বিজিবির সেকেন্ড ইন কমান্ড মাসুদুর রহমানসহ প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে ভারতে প্রবেশ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার সন্দীপ মিত্র ও বিলুপ্ত ছিটমহল বিনিময় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের নেতারা। সকালে বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের হাতীবান্ধা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন বাচ্চু ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান তাদের মিষ্টি মুখ করান ও ফুল দিয়ে বিদায় জানান। এ ছাড়া উভয় দেশে বিলুপ্ত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতারা বুড়িমারী বন্দরে মিষ্টি বিনিময় করেন। কমিটির ভারত ইউনিটের সভাপতি দ্বীপ্তিমান গুপ্ত, বাংলাদেশ ইউনিটের সভাপতি মঈনুল হক, সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, লালমনিরহাট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। উত্তর গোতামারী ছিটমহলের বাসিন্দা কানন বালা (৪৭) জানান, তার দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশে। মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনি ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশি মেয়ে ববিতা রানী (২৩) জানান, তার বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু বাবা-মা ভারতে যাচ্ছেন। গোতামারী ছিটমহলে মানিক ও স্বপ্নার ঘরে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে সন্তান। দুর্গাপূজার দশমীর দিনে জন্ম নেওয়া সন্তানের নাম রেখেছেন দশমী। স্বপ্না ২৮ দিনের দশমীকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, স্বামী-সন্তানের কথা ভেবে যেতেই হবে। গোতামারী ছিটমহলের বৃদ্ধ তারক নাথ (৯০) পরিবারের ১৩ জন ভারতে চলে গেলেন। বাংলাদেশে থাকবে দুই ছেলে। গতকাল সকাল থেকে কোনো কথা বলছেন না তারক নাথ। হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহবুবুর রহমান জানান, ৫৯টি ছিটমহলের ৪০টি পরিবারের ১৯৫ জন ভারতের নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করেছেন। ভারত গমনেচ্ছুদের কয়েকটি দলে ভাগ করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে ভারত চলে গেল ১৯টি পরিবারের মোট ৬৩ জন। জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, প্রথম দল হিসেবে উত্তর গোতামারী ছিটবাসীর ট্রাভেল পাসধারীরা চলে গেল। পর্যায়ক্রমে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব পাসধারীদের পাঠানো হবে। উল্লেখ্য, ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দী জীবনের মুক্তি মিলে ভারত বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষের। যার মধ্যে ১১১টি বাংলাদেশের এবং বাকি ৫১টি ভারতের ভ‚খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। এগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রামে ১২টি, লালমনিরহাট ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি এবং নীলফামারীতে রয়েছে ৪টি সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহল।

সর্বশেষ খবর