শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এখন শুধুই অপেক্ষা

মির্জা মেহেদী তমাল

এখন শুধুই অপেক্ষা

শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরে আইনি সব প্রক্রিয়া শেষ। শামিয়ানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ফাঁসির মঞ্চ। ডাকের অপেক্ষায় জল্লাদ শাহজাহান আর রাজু। কনডেম সেলে বন্দী দুই যুদ্ধাপরাধীকে রায় শোনানো হয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও বাকি নেই। কর্মকর্তাদের প্রাক-ফাঁসির বৈঠকও সম্পন্ন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তায় নেই কোনো ঘাটতি। এখন শুধুই অপেক্ষা, সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। ফাঁসির মঞ্চে কখন নেওয়া হবে কুখ্যাত দুই যুদ্ধাপরাধীকে এ খবরের অপেক্ষাতেই এখন বাংলাদেশ।

কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ফাঁসি কার্যকর করতে কোনো কাজ আর বাকি নেই। দুই যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা, তা তাদের জবানিতে শোনার অপেক্ষায় রয়েছি। ইতিমধ্যেই দুবার জানতে চাওয়া হয়েছে তাদের কাছে। তারা সময় নিয়েছেন। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন না করলে সচল হয়ে উঠবে ফাঁসির মঞ্চ। আর এটি হতে পারে আজকালই। এদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে থাকা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার জন্য কারাফটকের সামনে অপেক্ষা করে অবশেষে চলে গেছেন তার দুই ছেলে। তাদের হাতে বাবার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে কারা কর্তৃপক্ষের প্রতি লেখা আবেদন দেখা গেছে। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে কারাফটকের সামনে সাকা চৌধুরীর দুই ছেলে ফাইয়াজ কাদের চৌধুরী ও হুম্মাম কাদের চৌধুরীর সঙ্গে আসেন তাদের বাবার আইনজীবী হুজ্জাতুল ইসলাম। পরে বাবার সঙ্গে দেখা করতে না পেরে রাত সোয়া ১০টার দিকে চলে যান। আজ আবার দেখা করার চেষ্টা করবেন তারা। হুজ্জাতুল ইসলাম জানিয়েছেন, কারা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতেন তার দুই ছেলে। কিন্তু কারাগারে ঢুকতে যেসব কর্মকর্তার অনুমোদন লাগে, তারা সেখানে ছিলেন না। যে কারণে তারা ফিরে গেছেন। কারাগারে ঢোকার অনুমতি না পাওয়ার পর হুম্মাম কাদের চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বৃহস্পতিবার বাবার সঙ্গে দেখা হয় ঠিকই, কিন্তু তেমন কোনো কথা হয়নি। বাবা বলেছিলেন, আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করতে চান। তাদের কাছে তার মনের ইচ্ছাগুলো বলতে চান। সে কারণে আইনজীবীদের নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পেয়ে আইনজীবীরা চলে যান। রাতে আমরা একজন আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে আসি। কিন্তু এবারও অনুমতি পেলাম না। সাকা চৌধুরীর ছেলেরা বলেছেন, আজ আবার আসবেন। চেষ্টা করবেন অনুমতি নিয়ে সাক্ষাৎ করার। এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইনগতভাবে ব্যক্তিগত আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করার কোনো সুযোগ এখন নেই। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে বন্দী রয়েছেন এ দুই যুদ্ধাপরাধী। গতকাল দুজনই ছিলেন বিচলিত। তাদের আইনজীবীরা সাক্ষাতের জন্য পৃথকভাবে আবেদন জানালেও কারা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। কর্তৃপক্ষ বলছে, এ সময়ে আইনজীবীদের সাক্ষাতের কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে পারবেন, তবে তা কারা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাতে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত দুই যুদ্ধাপরাধী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের সংবাদ শুনতে উম্মুখ হয়ে আছে যেন দেশের মানুষ। গতকালও দিনভর সাংবাদিকরা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন সংবাদ সংগ্রহের জন্য। ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত গণজাগরণ মঞ্চ অবস্থান নিয়েছে শাহবাগে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বলেছেন, ‘সরকার আইনের বাইরে কিছু করবে না। আইনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা আছে, তার সবই করা হবে।’ প্রাণভিক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তারা মার্সি চাইতে পারেন। চাইলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’ কারা উপ-মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার বলেন, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুজনের কেউই প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেননি। তাদের কাছে দুবার সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হয়েছে। এখনো তারা এ বিষয়ে কিছু জানাননি।

প্রাণভিক্ষার বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখছেন সাকা-মুজাহিদ : প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি অনেকটা ঝুলিয়ে রেখেছেন যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না তারা। কারাসূত্র জানায়, গতকাল দুপুরে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা, তা জানতে সাকা ও মুজাহিদের সঙ্গে দেখা করেন সিনিয়র জেলসুপার জাহাঙ্গীর কবির ও জেলার নেছার আলম। কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সিনিয়র জেলসুপার ও জেলার সাকা-মুজাহিদের সঙ্গে এক থেকে দেড় ঘণ্টার মতো এ বিষয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা, তা স্পষ্ট করে কিছু বলেননি দুজনই। সূত্র আরও জানায়, প্রাণভিক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট না করলেও পরিবার এবং তাদের আইনজীবীর মাধ্যমেই জানাতে চান বলে আভাস দিয়েছেন। আইনি সব বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় এখন সাবেক এই দুই মন্ত্রীর সামনে কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগই বাকি আছে। তারা আবেদন না করলে বা রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা না পেলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে কারা কর্তৃপক্ষ, যার সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল থেকে রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর তাদের পড়ে শুনিয়েছি। ক্ষমা চাইবেন কিনা জানতে চেয়েছি। তারা বলেছেন, সিদ্ধান্ত পরে জানাবেন। তাদের সিদ্ধান্ত জানার জন্য আজও (শুক্রবার) গিয়েছি। এখনো তারা জানাননি।

মেডিকেল চেকআপ সম্পন্ন : সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মেডিকেল চেকআপ সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল দুপুরে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। তারা সুস্থ রয়েছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে দুজন কারা চিকিৎসক তাদের মেডিকেল চেকআপ সম্পন্ন করেন। মেডিকেল চেকআপে অংশ নেওয়া ডা. বিপ্লবকান্তি বিশ্বাস গতকাল বলেন, ‘আমরা সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের মেডিকেল চেকআপ করেছি। তারা সুস্থ আছেন। তাদের শারীরিক কোনো সমস্যা নেই।’ তার সঙ্গে ডা. হাবিব নামে আরও একজন কারা চিকিৎসক চেকআপে অংশ নেন বলেও জানান বিপ্লবকান্তি বিশ্বাস।

ফাঁসির প্রস্তুতি সম্পন্ন, প্রস্তুত জল্লাদ শাহজাহান-রাজু : দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে আবারও ডাকা হয়েছে দুই জল্লাদ শাহজাহান ও রাজুকে। জল্লাদ শাহজাহান ও রাজু অন্যদের চেয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সেই সঙ্গে সুঠাম দেহ ও অধিক মনোবলের কারণে জল্লাদদের তালিকা থেকে তাদের ডেকেছে কারা কর্তৃপক্ষ। এ দুজনের পাশাপাশি সাত্তার নামে আরও একজন জল্লাদকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারাসূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরে জল্লাদের ভ‚মিকা পালন করেন শাহজাহান। অন্যদিকে ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের সময় জল্লাদের ভ‚মিকায় ছিলেন রাজু। কারাসূত্র জানায়, ইতিমধ্যে মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীর ফাঁসির জন্য মঞ্চের প্রস্তুতি অনেকটাই সম্পন্ন হয়েছে। মঞ্চ ধোয়ামোছা শেষে টানানো হয়েছে শামিয়ানা। ফাঁসির মঞ্চের চুনকামও শেষ। এখন রায় কার্যকরের আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।

প্রাক-ফাঁসির বৈঠক সম্পন্ন সচিবালয়ে : দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন। গতকাল বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে সচিবালয়ে এ বৈঠক হয়। ধারণা করা হছে, এটিই ফাঁসির আগে উচ্চ পর্যায়ের চূড়ান্ত বৈঠক। একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বৈঠক শেষ করে আইজি (প্রিজন) দুপুর সাড়ে ১২টায় সচিবালয় থেকে বের হয়ে যান। বৈঠকে তিনি ফাঁসিসংক্রান্ত সব কাগজপত্রও বুঝে নেন। এরপর দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে স্বরাষ্ট্র সচিব সচিবালয় থেকে বেরিয়ে যান। একজন অতিরিক্ত সচিবও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

দিনভর জেলগেটে আইনজীবীরা : সাকা ও মুজাহিদের আইনজীবীরা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সাক্ষাতের আবেদন করলেও তারা অনুমতি পাননি। সাকা চৌধুরীর আইনজীবী হুজ্জাতুল ইসলাম খান আলফেসানী বলেন, ‘পরিবারের সদস্যরা আমাদের বলেছেন, প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। আমরা কারাগারে গিয়ে দেখা করার অনুমতি চেয়েছি। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি।’ মুজাহিদের আইনজীবী গাজী এইচ এম তামিম গতকাল সকালে বলেন, ‘আমরা পাঁচজন আজ (গতকাল) সকাল সাড়ে ১০টায় কারাগারে গিয়ে উনার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছিলাম। কারা কর্তৃপক্ষ আমাদের অনুমতি দেয়নি।’

মুজাহিদের পরিবারের সংবাদ সম্মেলন আজ : সুপ্রিমকোর্টের রিভিউ রায় পরবর্তী বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে আজ সংবাদ সম্মেলন করবে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পরিবার। বেলা ১২টায় সুপ্রিমকোর্টের অডিটরিয়ামে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর