রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর

পরিবারের বিদায়ী সাক্ষাৎ । লাশ পাঠানো হলো দুজনের গ্রামের বাড়ি

মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার ও বাদল নূর

সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর

রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে এক মঞ্চে ফাঁসি

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে পাশাপাশি ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়েছে। গত রাতে এ রায় কার্যকর করা হয়। রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে একসঙ্গে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৃশংসতম যুদ্ধাপরাধের হোতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে।

মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম অঞ্চলে নজিরবিহীন নিষ্ঠুরতার জন্য ‘সাকা চৌধুরী কোনো উদারতা পাওয়ার যোগ্য নন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন উচ্চ আদালত। আগামী মার্চে এ যুদ্ধাপরাধীর বয়স ৬৭ বছর হবে। বুদ্ধিজীবী  হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা ৬৮ বছর বয়সী মুজাহিদ সম্পর্কে আপিল বিভাগ বলেছিলেন, ‘এ ধরনের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ পাওয়ার পর অপরাধী সর্বোচ্চ দণ্ড না পেলে তা হবে ন্যায়বিচারের পরিহাস’। একাত্তরে নির্বিচারে অসংখ্য মানুষের প্রাণ সংহার করলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মরিয়া হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছেন এ দুই যুদ্ধাপরাধী। সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর রবিবার প্রথম প্রহরে তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়। আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন জানান, শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে একই মঞ্চে পাশাপাশি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। জল্লাদ শাহজাহান ও রাজু ফাঁসির রায় কার্যকর করেন। এর আগে মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীর প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর একাত্তরে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিতভাবে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন দেশের দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। গতকাল দুপুরে করা এ আবেদনটি রাত সাড়ে ৯টায় খারিজ করা হয়। এরপরই সাকা-মুজাহিদের পরিবারকে শেষ সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টা ৪৮ মিনিট পর্যন্ত সাকার পরিবার কারাগারে অবস্থান করে। রাত ১১টা থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত কারাগারের ভিতরে অবস্থান করে মুজাহিদের পরিবার। এরপরই রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে তাদের চূড়ান্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম দুই সাবেক মন্ত্রীকে একই সময়ে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হলো। শীর্ষ এ দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে কারাগার এলাকায় নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যা আগে কখনো নেওয়া হয়নি। র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির ছয় স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল কারাগারকে কেন্দ্র করে। এর পরও কারাফটকের সামনে ছিল হাজারো মানুষের ভিড়। দুই যুদ্ধাপরাধীর পরিবারের সদস্যরা কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশের সময় জনতা তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে চারটি অ্যাম্বুলেন্স কারাগারের ভিতর প্রবেশের সময় জনতা করতালি দিয়ে উল্লাস করতে থাকে। মিষ্টি বিতরণ হয় জেল গেটে। এ ছাড়া ফাঁসির খবর ছড়িয়ে পড়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ মিষ্টি বিতরণ করে। সূত্র জানায়, রায় কার্যকরের পর রাতেই সাকা-মুজাহিদের লাশ র‌্যাব-পুলিশের পাহারায় অ্যাম্বুলেন্সে করে চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমরা তাদের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেব। তার পরের কাজ তাদের পরিবার করবে।’ কারাগার সূত্র জানিয়েছে, ফাঁসি দেওয়ার পর নিয়মানুযায়ী তাদের দেহ প্রায় ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর কিছু প্রক্রিয়া শেষে কারাগারের চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। ফাঁসি কার্যকরের সময় উপ-কারা মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার, ঢাকা জেলার প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেসার আলম ও ডেপুটি জেলার শিরিন আক্তার, ঢাকার সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম এবং দুজন কারা চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন। একজন কর্মকর্তা জানান, সব কর্মকর্তাকে মুঠোফোন ফটকে রেখে ভিতরে ঢুকতে হয়েছে। কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, সন্ধ্যা ৭টার পর সাকা ও মুজাহিদকে রাতের খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কিছুই খাননি। এরপর কারারক্ষীরা তাদের গোসল করতে বলেন। তারা গোসল সেরে নিজের সেলে বসে থাকেন। মুজাহিদ নামাজ ও দোয়া পড়তে থাকেন। রাত সাড়ে ৯টার পর সাকার সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে আসেন। এক ঘণ্টা ১৮ মিনিট তারা একান্তে কথা বলেন। অন্যদিকে রাত ১১টায় মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা যান। সেখানে সোয়া ঘণ্টা সময় কাটান তারা।

সূত্র জানায়, সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের শারীরিক চেকআপ করার জন্য দুজন চিকিৎসক ও তওবা পড়ানোর জন্য মসজিদের ইমাম মুনির হোসাইন রাত ১০টা ৪০ মিনিটে কারাগারে প্রবেশ করেন। চিকিৎসকরা হলেন ঢাকার সিভিল সার্জন এম এ মালেক ও কারা চিকিৎসক আহসান হাবীব।

কারাসূত্র জানান, রাত সোয়া ১২টার দিকে কারা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মুনির হোসাইন সাকা চৌধুরীকে তওবা পড়ান। তবে মুজাহিদ নিজের তওবা নিজেই পড়েন।

ফাঁসি দেওয়ার প্রক্রিয়ার সময় ভিতরে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা রাতে বলেন, রাত সাড়ে ১২টার দিকে চারজন জল্লাদ সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের সেলে যান। এ সময় তারা তওবা শেষ করে বসে ছিলেন। তাদের পিছমোড়া করে হাত বেঁধে ফেলেন জল্লাদরা। একজন জল্লাদ কালো কাপড়ের যমটুপি পরিয়ে দেন তাদের। এ সময় সাকা চিৎকার করে কথা বলার চেষ্টা করেন। মুষড়ে পড়েন তিনি। জল্লাদরা যমটুপি পরিয়ে তাকে সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। তবে মুজাহিদ ছিলেন নির্বাক। মঞ্চে ওঠানোর আগে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা কর্মকর্তারা দেখে নেন। রাত ১২টা ৫০ মিনিটে তাদের ফাসির মঞ্চে তোলা হয়। ঠিক ১২টা ৫৫ মিনিটে হাতে থাকা লাল রুমাল ফেলে সংকেত দেন কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক। সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির মঞ্চের লিভার টেনে ধরেন জল্লাদ। দুজনই গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঝুলে পড়েন। ফাঁসি কার্যকর হয় একসঙ্গে দুই যুদ্ধাপরাধীর। এরপর বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত ২টা ৫২ মিনিটে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স পুলিশের কঠোর পাহারায় চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হয়।

সাকার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে কারাগার ছেড়েছেন তার স্বজনরা। শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় কারাগারে প্রবেশ করে এক ঘণ্টা ১৮ মিনিট অবস্থান করেন তারা। সাক্ষাৎ শেষে বের হয়ে সাকার ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি ফালতু। আমার বাবা (সাকা চৌধুরী) রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি। প্রাণভিক্ষার এমন কাগজ এ সরকারের আমলে আরও বের হবে। বর্তমান সরকার তাকে (সাকা চৌধুরী) নির্বাচনে হারাতে না পেরে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করছে বলেও মন্তব্য করেন হুম্মাম কাদের। সূত্র জানায়, শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় সাকা চৌধুরীর পরিবারের ১৮ জন সদস্য কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কারাগারে প্রবেশ করেন। কারাগারের ভিতরে প্রবেশকারীদের মধ্যে ছিলেন সাকার স্ত্রী, দুই ছেলে, মেয়ে, মেয়ের জামাই, দুই ভাই, বোন, দুই ভাবী, বড় ছেলের বউ, শ্যালিকা, ভাগ্নি, চাচি, শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী প্রমুখ। এর আগে রাত সোয়া ৮টায় কারা কর্তৃপক্ষ শেষ সাক্ষাতের জন্য ফোনে সাকার পরিবারের সদস্যদের ডেকে পাঠালে ৩৫ জন সদস্য কারাফটকে এসে উপস্থিত হন। দুটি গাড়িযোগে তারা আসেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ ৩৫ জনের মধ্য থেকে ওই ১৮ জনকে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে কারাগারের ভিতরে পাঠান।

মুজাহিদের শেষ সাক্ষাৎ : মুজাহিদের সঙ্গে দেখা করতে যান স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ভাই এবং শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন আত্মীয়। রাত পৌনে ১১টায় তারা কারাগারের ভিতরে প্রবেশ করেন। বেরিয়ে আসেন ১২টা বাজার কয়েক মিনিট আগে।

কারাগারে চিকিৎসক ও ইমাম : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের শারীরিক চেকআপ করার জন্য দুজন চিকিৎসক কারাগারে প্রবেশ করেন। এ ছাড়া তওবা পড়ানোর জন্য একজন ইমামও প্রবেশ করেন। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে তারা কারাগারে প্রবেশ করেন। তারা হলেন ঢাকার সিভিল সার্জন এম এ মালেক ও কারা চিকিৎসক আহসান হাবীব। এ ছাড়া কারা মসজিদের ইমাম মুনির হোসাইন। ফাঁসি কার্যকর করতে সন্ধ্যা থেকেই নানা তৎপরতা শুরু করে কারা প্রশাসন। কয়েক দফা বৈঠকের পর সময় ঠিক করা হয় রাত সাড়ে ১০টা। সে অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের আগেই কারাগারে আসতে থাকেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। রাত ৯টার কিছু আগে কারাগারে আসেন ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। এরপর যান ঢাকার সিভিল সার্জনের প্রতিনিধি। রাত ৯টার কিছু আগে কারাফটকের আর্চওয়ে স্ক্যানার যন্ত্রটি পরিবর্তন করে র‌্যাবের আনা অত্যাধুনিক একটি স্ক্যানার বসানো হয়। এর আগে সন্ধ্যা থেকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কমুখী সব কটি পথ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। গণমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া ওই সড়কে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আশপাশের ভবনগুলোর ছাদেও পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট : এর আগে রাত ৮টার পর থেকে বদলে যেতে থাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিত্র। কারাগারকে ঘিরে ছয় স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। খবর দেওয়া হয় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পরিবারকে। কারাগারের সামনে থাকা সংবাদকর্মীরা অনুমান করে নেন, যে কোনো সময় অবসান ঘটবে সবকিছুর। এ সময় কারাগারের ভিতরে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিতে থাকে কর্তৃপক্ষ। একে একে আসতে থাকেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। প্রস্তুত তখন ফাঁসির মঞ্চ। আলো জ্বলে ওঠে কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে। গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢাকা জেলা প্রশাসনের দুই ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফুল ইসলাম ও তানভীর আহমেদ দীর্ঘ সময় আলোচনার পর দুই যুদ্ধাপরাধীর প্রাণভিক্ষার আবেদন গ্রহণ করেন। আবেদন দুটি দুই ডেপুটি জেলার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যান। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আবেদনটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকে আবেদনটি আইনমন্ত্রীর বাসভবন হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে স্বরাষ্ট্র সচিব মোজাম্মেল হক খান ও আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক বঙ্গভবনে নিয়ে যান। রাষ্ট্রপতি সে আবেদন খারিজ করেন। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞের দায়ে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। সে রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলে এ বছরের ১৬ জুলাই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। আর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টম্বর। মুজাহিদ চূড়ান্ত ওই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন ১৪ অক্টোবর। গত বুধবার (১৮ নভেম্বর) একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে তার আবেদন খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। চূড়ান্ত রায়ের পর মুজাহিদের একটি মাত্র পথই খোলা ছিল। আর তা হলো দোষ স্বীকার করে নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া। কেননা, সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না তার। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে মাথা নিচু করে সে পথেই যান তিনি। মূলত এর মধ্য দিয়েই মুজাহিদের সব ঔদ্ধত্যের অবসান ঘটে। যে যুদ্ধাপরাধীদের অস্তিত্বহীনতার কথা তিনি বলেছিলেন, এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, তিনি নিজেই সেই যুদ্ধাপরাধী। ফলে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতে (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব) থাকা নেতা হিসেবে গণহত্যা সংঘটিত করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদি ঘটনার দায়ে ফাঁসির দড়িতেই ঝুলতে হলো মুজাহিদকে। ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বা বিচার শেষ হওয়া যে কোনো মামলার তুলনায় সাকার মামলাটি সবচেয়ে বড় কলেবরের। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চসংখ্যক ২৩টি অভিযোগ গঠন করা হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০টি অভিযোগ ছিল জামায়াত নেতা সাঈদীর বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যাসহ চার হত্যা-গণহত্যার দায়ে ফাঁসি দেওয়া হয় সাকাকে। এখন পর্যন্ত রায় কার্যকর হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সাজা পাওয়া অপরাধের মধ্যেও এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা-গণহত্যা, ব্যাপক নিধনযজ্ঞ, দেশান্তর, নির্যাতন, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন করে হত্যা, ষড়যন্ত্রের মতো বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে। এর মধ্যে সাকা চৌধুরীকে যে চার হত্যা-গণহত্যার দায়ে ফাঁসির কাষ্ঠে যেতে হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সমাজসেবী-দানবীর অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে তিনজনকে হত্যা, রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ৫০-৫৫ জনকে হত্যা এবং চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে হত্যা। ট্রাইব্যুনালে সাকার বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে এসব অভিযোগ ছিল যথাক্রমে ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বরে। আরও চারটি অপরাধে আদালত সাকাকে ৫০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিলেও সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হওয়ায় সেসব সাজা ভোগের প্রয়োজন পড়েনি।

সর্বশেষ খবর