রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

প্রাণভিক্ষা, দিনভর নাটকীয়তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

একাত্তরের আলবদর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৃশংসতম যুদ্ধাপরাধের হোতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর একাত্তরে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিতভাবে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন দেশের দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। গতকাল দুপুরে করা এ আবেদনটি রাত ৮টায় নাকচ করা হয়।

গতকাল দুপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢাকা জেলা প্রশাসনের দুই ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফুল ইসলাম ও তানভির আহমেদ দীর্ঘ সময় আলোচনার পর দুই যুদ্ধাপরাধীর এই আবেদন গ্রহণ করেন। প্রাণভিক্ষার আবেদনটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে আবেদনটি আইনমন্ত্রীর বাসভবন হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং সর্বশেষ যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি তাদের এই আবেদন খারিজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও এর বিচার নিয়ে হুঙ্কার ছাড়া দুজন অপরাধীর স্বীকারোক্তি দেশের ইতিহাসে আর একটি যুগান্তকারী ঘটনা বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। আর এর মধ্য দিয়ে প্রাণ রক্ষার সর্বশেষ সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করেন একাত্তরের আলবদর প্রধান মুজাহিদ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৃশংসতম যুদ্ধাপরাধের হোতা সাকা চৌধুরী। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার করেছিলেন জামায়াতের এই সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। তিনি নিজেই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী আর গণহত্যার মাস্টারমাইন্ডদের অন্যতম। দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, কোনো স্বাধীনতাবিরোধী নেই বলে দম্ভোক্তি করেছিলেন তিনি। কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর লিখিত আবেদনে নিজেকেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে লিখিত স্বীকারোক্তি দিয়েছেন মুজাহিদ। একই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সাকা চৌধুরী। যা এর আগে ফাঁসি কার্যকর হয়ে যাওয়া আর কোনো যুদ্ধাপরাধী করেননি। প্রাণভিক্ষার এই আবেদন নিয়ে দিনভর নানা নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়। শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধী প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও পরিবারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে। জামায়াতও বিবৃতি দিয়ে বলেছে, এটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতেই বলা হচ্ছে। সাকা ও মুজাহিদকে তাদের শেষ পরিনতি থেকে রক্ষায় পরিবারের সদস্যরা ছিলেন ভীষণ তৎপর। দিনভর তারা দৌড়ঝাপ করেছেন বিভিন্ন স্থানে। কারাগার থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত তারা ছুটেছেন। সাকার পরিবার ও আইনজীবীরা সকাল থেকেই কারাগারের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন। তারা সাকার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কয়েক দফা আবেদন করেন। মুজাহিদের পরিবারও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার যে দাবি নতুন করে করা হচ্ছে তা নেহায়েতই ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য বলে মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতরাতে রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসায় তিনি এ মন্তব্য করেন। এর আগে ফাঁসির রায়ের রিভিউ আবেদন খারিজ ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায় পড়ে শোনানোর পর কারা কর্তৃপক্ষ দু’দফা এ দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর কাছে ক্ষমা চাইবেন কি-না, তা জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে উল্লেখ করেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরী। যদিও চূড়ান্ত এ ক্ষণে সে ধরনের কোনো সুযোগ নেই আইনে। সর্বশেষ গতকাল সকালে তৃতীয় দফায় তাদের ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে জানতে মুজাহিদ ও সাকার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে যান ঢাকা জেলা প্রশাসনের দুই ম্যাজিষ্ট্রেট আশরাফুল ইসলাম ও তানভির আহমেদ। ম্যাজিষ্ট্রেটদের সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষের হয়ে কথা বলতে যান সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেসার আলম ও ডেপুটি জেলার শিরিন আক্তারও। ম্যাজিস্ট্রেটরা কারাগার থেকে বের হয়ে গেলেও তারা মিডিয়ার সামনে কোনো কথা বলেননি। তবে মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী তাদের কাছেই লিখিত আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন বলে কারা সূত্র জানায়। কারা সূত্র জানায়, প্রাণভিক্ষার আবেদন মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয় হয়ে পাঠানো হয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের গুলশানের বাসায়। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল প্রস্তুত হয়ে মন্ত্রীর বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

বাবা প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেননি বলে দাবি করেছেন তার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ন্যায়বিচার পাননি।’ গতকাল রাতে কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। বিদায়ী সাক্ষাতের সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কি বলেছেন- জানতে চাইলে হুম্মাম কাদের বলেন, তার বাবা জানিয়েছেন তিনি কখনই প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি। এটা একেবারেই মিথ্যা। এ রকম বাজে কথা (প্রাণভিক্ষা) কে বলেছে? হুম্মাম বলেন, বাবা বলেছেন, তিনি কোনো কাগজে স্বাক্ষর করেননি। তিনি বলেছেন, যে কাগজ বের হয়েছে, এ ধরনের কাগজ আরও কত দেখবে সামনে। তিনি আরও বলেছেন, নির্বাচনে হারাতে পারেনি তাই একটু পর তার জান নিয়ে নেওয়া হবে।

বাবা প্রাণভিক্ষা চাননি : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গে কারাগারে স্বজনদের সাক্ষাৎ শেষে মুজাহিদের ছেলে আলী আহমদ মাবরুর সাংবাদিকদের বলেন, তার বাবা প্রাণভিক্ষা চাননি। দোয়া চেয়েছেন। এরা আগেও মিথ্যাচার করেছে, এখনো করছে। রাত সোয়া ১২টার দিকে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন মুজাহিদের স্বজনরা। এর আগে রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে কারাফটকে পৌঁছান তারা। মাবরুরসহ অন্তত ১১ জন স্বজন মুজাহিদের সঙ্গে দেখা করেন।

সর্বশেষ খবর