সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কারাগারে শেষ কয়েক ঘণ্টা

মির্জা মেহেদী তমাল ও সাখাওয়াত কাওসার

ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের শেষ কয়েক ঘণ্টা কেমন কেটেছে। কেমন ছিল তাদের মনের অবস্থা। কীভাবে তাদের ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হলোÑ ব্যাপক অনুসন্ধানে এমন সব নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী কারা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কারারক্ষীদের কাছে জানা গেছে তাদের জীবনের শেষ মুহূর্তের কিছু কথা।

জানা গেছে, জীবনের শেষ দিন শনিবার ফাঁসি নিয়ে কারাগারের বাইরে টানটান উত্তেজনা দেখা দিলেও ভিতরে এর রেশ খুব একটা ছিল না। ফাঁসির প্রস্তুতি নিয়ে সবাই যেমন তৎপর ছিল, তেমনি সাধারণ মানুষও এর শেষ জানতে উম্মোখ হয়ে ছিলেন। দিনভর মানুষ টিভির সামনে বসে ছিলেন  সর্বশেষ খবর জানতে। মিডিয়াকর্মীরাও খবর সংগ্রহে দিনভর ছিলেন ব্যস্ত। কারা সূত্রে জানা গেছে, এসবের কিছুই জানতে পারেননি সাকা-মুজাহিদ। দুপুরে দুই ম্যাজিস্ট্রেট তাদের কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়ে যখন কথা বলেন, তখনো সাকা চৌধুরী তার স্বভাবসুলভ অনুযায়ী তাচ্ছিল্য নিয়ে কথা বলেছিলেন। দীর্ঘ সময় পর তার প্রাণভিক্ষার আবেদন করলে বেরিয়ে আসেন দুই ম্যাজিস্ট্রেট। তবে এদিন সাকা চৌধুরী নামাজ আদায় করেছেন।

শরীরটা তো ঠিক রাখা চাই : শনিবার দুপুরে কারা চিকিৎসকরা যান সাকা আর মুজাহিদের কনডেম সেলে। এ সময় সাকা চৌধুরী তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে থাকেন। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে বলেন, ‘আপনি আমাদের মেহমান। আপনার শরীর-স্বাস্থ্য দেখার দায়িত্ব আমাদের।’ তখন সাকা চিকিৎসককে বলেন, ‘ঠিক আছে, তোমাদের যা মন চায় করো।’ এরপর চিকিৎসকরা যান মুজাহিদের সেলে। চিকিৎসকরা তার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার কথা বললে মুজাহিদ তাদের বলেন, ‘অবশ্যই পরীক্ষা করবেন। শরীরটা তো ঠিক রাখতে হবে। যতক্ষণ বেঁচে থাকব, ততক্ষণ স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। এক মিনিটও যদি বেঁচে থাকি, তবু স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে।’

শেষ ইচ্ছা নেই : সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ তাদের কোনো শেষ ইচ্ছার কথা জানাননি। ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের আগে যথারীতি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের কাছে জানতে চাওয়া হয় শেষ ইচ্ছার কথা। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানাননি। এর আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও কোনো শেষ ইচ্ছার কথা জানাননি বিএনপি-জামায়াতের এই দুই নেতা। জেলগেট থেকে বের হয়ে সাকা চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেন, ‘বাবা আমাদের ভাইবোনদের একসঙ্গে থাকতে বলেছেন। আর আমার মাকে দেখে রাখার কথা বলেছেন।’ মুজাহিদ তার পরিবারের সদস্যদের শেষ কথায় বলেছেন, ‘আমার জন্য দোয়া করো। আর সবাইকে সালাম দিয়ো।’

‘শেষ খাবারের প্লেট’ ছুড়ে দেন সাকা : ফাঁসি নিশ্চিত। তা জেনেও সেই চিরাচরিত দম্ভে মৃত্যুর আগে শেষ খাবারের প্লেট ছুড়ে মারেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতিতে অংশ নেওয়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারা কর্মকর্তা জানান, ফাঁসির আগে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদকে খাবার খেতে দেওয়া হয়। খাবারের তালিকায় ছিল মুরগির মাংস ও সবজি। খাবার দেওয়া হলে সাকা চৌধুরী খাবারের প্লেট ছুড়ে মারেন। তখন তাকে বলা হয়, ‘এটি আপনার শেষ খাওয়া।’ তখন তিনি প্লেট তুলে খেয়ে নেন। তবে শেষ খাবার বলা হলেও মুজাহিদ তা স্পর্শ করেননি।

যমটুপি পরতে চাননি সাকা : পরিবারের সদস্যদের বিদায়ের পর রাত সাড়ে ১২টার দিকে তওবা পড়ানো হয়। তওবা পড়ান কারাগার পুকুরপাড়-সংলগ্ন মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মনির হোসেন খান। সাকা তওবা পড়লেও মুজাহিদ বলেন, ‘আমাকে তওবা পড়াতে হবে না। আমি নিজেই তওবা পড়েছি।’ এরপর ১২টা ৩৬ মিনিটে কনডেম সেলে যান চার জল্লাদ। এ সময় সাকাকে যমটুপি পরাতে গেলে তিনি বকাঝকা করেন। তিনি যমটুমি পরতে চাননি। তার হাতে হাতকড়া পরাতে গেলেও হৈচৈ করেন। সাকা তখন বলেন, ‘এগুলো লাগবে না। আমি একাই যাব মঞ্চে। মিথ্যা অভিযোগে আমারে নিয়ে যাচ্ছ। আবার যমটুপি পরতে কেন বলো!’ একপর‌্যায়ে তিনি রাজি হন টুপি ও হাতকড়া পরতে। অপরদিকে মুজাহিদকে টুপি পরাতে গেলেও তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তিনি ছিলেন নির্বিকার।

যেভাবে কার্যকর করা হলো ফাঁসি : একই সময় একই মঞ্চে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মুজাহিদকে গোসল করানো হয়। ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে দেওয়া হয় রাতের খাবার। খাবারের মেনু ছিল মুরগি, ডাল ও সবজি। তখন সালাউদ্দিন খেলেও মুজাহিদ খাননি। ৯টা ৩৫ মিনিটে শেষবারের মতো দেখা করতে কারাগারে ঢোকেন সাকার পরিবারের সদস্যরা। তারা অবস্থান করেন ১০টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। সালাউদ্দিন কাদেরের পরিবার বের হলে ঢোকেন মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা। তারা অবস্থান করেন সোয়া ১২টা পর্যন্ত। এরপর ১২টা ৩৬ মিনিটে কনডেম সেল থেকে যমটুপি পরিয়ে দুজনকে একসঙ্গে ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। ধীর পায়ে। দুজনই এ সময় দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন। চার জল্লাদ সাকাকে ধরে ছিলেন। ফাঁসির মঞ্চের ডান পাশে দাঁড় করানো হয় সাকাকে, সাকার বাঁ পাশে দাঁড় করানো হয় মুজাহিদকে। তাদের মঞ্চে ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই দড়ি দেওয়া হয় গলায়। দড়ি দেওয়ার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই তারা ঝুলে পড়েন। এর আগে লিভার ধরে টান দেন জল্লাদ শাহজাহান। মিনিট বিশেক তাদের ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফাঁসির মঞ্চের অন্ধকার কূপে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর