সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সেই ডালিম হোটেল এখন

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

নাম ছিল ‘মহামায়া ভবন।’ স্বাধীনতাবিরোধী নরপশুরা ভবনটি দখল করে নিয়ে নাম দেয় ডালিম হোটেল। চট্টগ্রাম নগরীর নন্দন কানন টিএন্ডটি অফিসের পেছনে পুরনো এ ভবনটি এখনো হাজারো মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালি জাতির রক্ত এবং নির‌্যাতনের স্মৃতি বহন করছে। ৪৪ বছর আগে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের বন্দী করে এ ভবনে এনে শরীরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বইয়ে দেওয়া হয় রক্তের বন্যা। এ ভবনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, নির্মম অত্যাচার-নির‌্যাতনের কথা মনে পড়লে ভয়ে আঁতকে ওঠেন ঘটনার শিকার মুক্তিযোদ্ধারা ও বাঙালিরা। মূলত জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাসেম আলীর হাতে এ ভবন পরিণত হয় কসাইখানায়। যার শিকার হন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি।  ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’ বইয়ের লেখক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ডালিম হোটেল কসাইখানায় পরিণত হয়। এখানে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আল বদর বাহিনী শত শত বাঙালিকে ধরে এনে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডালিম হোটেল থেকে অনেক বাঙালিকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।’ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. গাজী সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রামে আল বদর বাহিনীর মাস্টার মাইন্ড ছিলেন মীর কাসেম আলী। তার নির্দেশনা ও নেতৃত্বে ডালিম হোটেলে চলত মুক্তিকামীদের ওপর অমানুষিক নির‌্যাতন।’ তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭১ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ‘মহামায়া ভবন’ দখল করেন মীর কাসেম আলী। ভবনের মালিকরা হিন্দু। ভবনটি আলবদর বাহিনী নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর এর নাম দেওয়া হয় ‘ডালিম হোটেল’। হোটেল শুধু নামেই। আড়ালে চলতে থাকে মুক্তিকামী মানুষ নির‌্যাতন। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন বাঙালিকে ডালিম হোটেলে ধরে এনে রড ও বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির‌্যাতন করা হতো। নির‌্যাতিতদের বেশির ভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। ডালিম হোটেলে নির‌্যাতনে মরণাপন্ন লোকজন যখন পানি চাইত তখন নরপশুরা পেশাব করে তা খেতে দিত। পেশাব খেতে না চাইলে নির‌্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে খেতে বাধ্য করত আল বদর বাহিনী। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন পরও ডালিম হোটেলের আশপাশ এলাকায় অসংখ্য লাশ পড়ে ছিল। ডালিম হোটেলে নির‌্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সাংবাদিক নাছিরুদ্দিন চৌধুরী, ন্যাপনেতা সাইফুদ্দিন খান, তৎকালীন জেলা ন্যাপের সভাপতি এ এন নূরুন্নবী, ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের দুই কর্মকর্তা অরুণ কুমার চৌধুরী, শফিউল আলম চৌধুরী, ড. ইরশাদ কামাল খান, ড. মোসলেহ উদ্দিন খান, জেলা ন্যাপের তৎকালীন নেতা অ্যাডভোকেট শফিউল আলম (বেবী শফি), জাহাঙ্গীর চৌধুরী, তৎকালীন চীনপন্থি ন্যাপনেতা মো. সেলিম এবং মেজবাহ খান। প্রয়াত ন্যাপনেতা সাইফুদ্দিন খানের স্ত্রী নারীনেত্রী নূরজাহান খান জানান, ‘ডালিম হোটেলে সাইফুদ্দিন খানকে ১২ দিন আটকে রেখে মীর কাসেম আলী অমানুষিক নির‌্যাতন চালায়। আল বদর বাহিনী ওই সময় বাঙালিদের ধরে এনে লোহার রড ও বিদ্যুতিক শক দিয়ে নির‌্যাতন চালাত।’

নির‌্যাতনের পুরস্কার : মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মীর কাসেম চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। হত্যা ও নির‌্যাতনে নৈপুণ্যের পুরস্কার হিসেবে তাকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে ইসলামী ছাত্রসংঘকে যখন আল বদর বাহিনীতে পরিণত করা হয় তখন মীর কাসেম আলী এ বাহিনীর তিন নম্বর ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পান। তখন আল বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী। দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মীর কাসেম আলী সৌদি আরবে পালিয়ে যান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মীর কাসেম আলী দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্রসংঘকে ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’ নাম দিয়ে মীর কাসেম আলীকে এর সভাপতি করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর