সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
বলতেন কীসের মুক্তিযুদ্ধ!

‘বিরাট রাজনীতিক’ মুজাহিদ জামানত রক্ষায় ব্যর্থ

কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর

জামায়াতে ইসলামীর ‘বিরাট রাজনীতিক’ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ; দেশময় এ রকম প্রচারণাই ছিল। ট্র্যাজেডি হলো, এই বিরাট রাজনীতিক তিনবার ভোটে দাঁড়িয়ে একবারও নিজের জামানত রক্ষা করতে পারেননি। এ জন্য তার ‘খ্যাতি’ ছিল। পাশাপাশি ছিল কুখ্যাতিও। সেটা মুক্তিযুদ্ধকে অবহেলা করার জন্য। তিনি বলতেন ‘কীসের মুক্তিযুদ্ধ! একাত্তরে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। হয়েছে গণ্ডগোল। কখনই মুক্তিযুদ্ধ হয়নি।’ বলা হয় মুজাহিদ দেশবাসীর সঙ্গে ভয়ানক ঠাট্টা করেছেন ২০০১ সালে। যে দেশের জš§ রুখতে তিনি নরহত্যায়ও কার্পণ্য করেননি, সেই বছর মন্ত্রী হয়ে তিনি ওই দেশেরই জাতীয় পতাকা উড়িয়ে সরকারি গাড়ি হাঁকানো শুরু করেছিলেন। জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মুজাহিদ ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এবং ২০০৮ সালে জোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে অংশ নেন। তিনবারই তিনি জামানত হারান। মুজাহিদের জš§ ১৯৪৭ সালে ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুরে পৈতৃক বাড়িতে। ছেলেবেলা কেটেছে ফরিদপুরেই। বাল্যকালে পশ্চিম খাবাসপুরের স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ালেখা করেন। পড়ে ভর্তি হন ফরিদপুর জিলা স্কুলে। জিলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএ পাস করেন। কলেজে থাকতেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। সে সময় তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা। পরে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ালেখা করেন। মুজাহিদ ১৯৭১ সালে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আলবদর বাহিনীর নেতা মুজাহিদ আÍগোপনে চলে যান। ১৯৮২ সালে তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য হন। ১৯৮৯ সালে নিযুক্ত হন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। ২০০০ সালে হন সেক্রেটারি জেনারেল। মুজাহিদের ভাই আলী আফজাল মোহাম্মদ খালেছ জানান, ১৯৬৮ সালে মুজাহিদ ফরিদপুর ছাড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ঢাকাতেই অবস্থান করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু দিন ফরিদপুরে থাকলেও পরে স্থায়ীভাবে ঢাকাতেই বসবাস করেন। রাজনীতির কারণে মাঝেমধ্যে ফরিদপুরে আসতেন। সমাজকল্যাণমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রতি সপ্তাহেই ফরিদপুরে আসতেন। ফরিদপুরে এলে পশ্চিম খাবাসপুরের বাড়িতেই উঠতেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে আটক করা হয় মুজাহিদকে। পরে একই বছরের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালে মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে প্রসিকিউশন। বিচার শুরু হয় ২০১২ সালের ২১ জুন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পরে মুজাহিদ এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে চলতি বছরের ১৬ জুন মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এরপর তিনি মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। তার সে আবেদনটিও খারিজ হয়ে যায়। সর্বশেষ তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার যে আবেদন করেন তা-ও নাচক হয়ে যায়।

সাত অভিযোগে বিচার : মানবতাবিরোধী অপরাধে মুজাহিদের সাতটি অভিযোগে বিচার হয়েছে। এর মধ্যে বিচারিক আদালতে তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। একটি অভিযোগে চার বছর ও একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। প্রমাণিত না হওয়ায় দুটি অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পান। আপিলে অন্য একটি অভিযোগ থেকে খালাস পান তিনি। তবে প্রমাণিত হয় চারটি অভিযোগ। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। দুটি অভিযোগে বিচারিক আদালতের দেওয়া দণ্ড বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। আর ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড হলেও দণ্ড কমিয়ে একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়।

রইল বাকি দুই : মানবতাবিরোধী অপরাধে যে কজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে চারজনের বাড়িই ফরিদপুরে। ইতিমধ্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রায় কার্যকর হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরও দুজন বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন। তারা হলেন জামায়াত সমর্থক হিসেবে পরিচিত মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও নগরকান্দা পৌরসভার বরখাস্তকৃত মেয়র, বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন। রায় ঘোষণার পরপরই তারা গোপনে বিদেশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। দুজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় খুশি ফরিদপুরবাসী। পলাতক দুই আসামিকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হলে ‘ফরিদপুর হবে পুরোপুরি কলঙ্কমুক্ত’- ফরিদপুরবাসীর এটাই প্রত্যাশা।

সর্বশেষ খবর