মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
নয়া ফর্মুলায় বিদ্যুৎ খাতে লুটের আয়োজন

বিনা টেন্ডারে লক্ষাধিক কোটি টাকার ১৫ প্রকল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিনা টেন্ডারে লক্ষাধিক কোটি টাকার ১৫ প্রকল্প

বিদ্যুৎ খাতে এবার নতুন ফর্মুলায় লুটপাটের অভিনব আয়োজন শুরু হয়েছে। দরপত্র ছাড়াই বাস্তবায়নের পাঁয়তারা চলছে লক্ষাধিক কোটি টাকার ১৫টি প্রকল্প। আর এক্ষেত্রেও সামনে দাঁড় করানো হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটিকে। এই আইন সামনে রেখেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ব্যয়বহুল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে যার দায় চাপানো হয়েছে সাধারণ মানুষের কাঁধে।

জানা গেছে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে কঠিন শর্তের (আনসলিসিটেড বা অযাচিত ঋণ) এক লাখ দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি বিষয়টি বিবেচনার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) চিঠি পাঠানো হয়েছে।

প্রস্তাব অনুযায়ী ঋণের টাকা থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পে ১০৫ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের দুটি প্রকল্পে ৫৯৭ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের একটি প্রকল্পে তিন হাজার মিলিয়ন ডলার, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের দুটি প্রকল্পে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি  প্রকল্পে এক হাজার ৩২২ মিলিয়ন ডলার, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের একটি প্রকল্পে ২ হাজার ৬০ মিলিয়ন ডলার, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি প্রকল্পে তিন হাজার ৩৯৩ মিলিয়ন ডলার, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের একটি প্রকল্পে ১৬ মিলিয়ন ডলার, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের চারটি প্রকল্পে দুই হাজার ৪৩৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।

তবে সূত্র মতে, খোদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চায় না আনসলিসিটেড ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হোক। কারণ, এসব ঋণে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। শুধু বিশেষ ক্ষেত্র ও রাষ্ট্রের অতি জরুরি প্রয়োজনেই এ ধরনের ঋণ নেওয়া হয়। অবশ্য কয়েক মাস আগেই বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া আনসলিসিটেড প্রস্তাব পরিহার মর্মে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। গত ১২ আগস্ট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও পাঠানো হয়। এর মধ্যেই কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে দরপত্র ছাড়া বৃহৎ এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের অনুমোদন করিয়ে নিতে তোড়জোড় শুরু করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আনসলিসিটেড ঋণের বিষয়টি হলো- কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে। তারাই অর্থায়নের উৎসের সন্ধান দেবে এবং পুরো বিষয়টি সমন্বয় করবে। তবে এক্ষেত্রে ঋণে সুদের হার বা অন্যান্য শর্ত নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ থাকে না বিধায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুদের হার হয় বেশি। থাকে নানা শর্ত। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার সুযোগও থাকে না। তাই পণ্যের দাম বেড়ে যায় কিন্তু মান নিশ্চিত করা যায় না। এতে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী লাভবান হলেও দেশ ও বিদ্যুৎ খাতের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, দেশের ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়ার বিকল্প নেই। আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর মেয়াদ এখনো রয়েছে। তাই এর আওতায় এসব প্রকল্প অনুমোদন করা যেতেই পারে।

এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেখানে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অর্থের সংস্থান করে সেটা মূলত সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট। এক কথায় বললে দেশের অর্থনীতির জন্য এটা হারাম। অনেক সময় সরকারও এ ধরনের ঋণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। তখন ঋণদাতার নানা শর্ত মেনে প্রকল্পের কাজ করতে হয়। অনেকক্ষেত্রে প্রকল্পের কাজও দিতে হয় ঋণদাতার পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে। এসব ক্ষেত্রে সরবরাহ বা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ৮ টাকার পণ্য ৮০ টাকা দর দিলেও করার কিছু থাকে না। প্রথমে এটাকে ভালো মনে হতে পারে, কয়েক বছর গেলেই এর ক্ষতিকর দিকগুলো সামনে আসতে থাকে। লাভ বেশি হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে ঋণদাতাই গ্রাহককে ঋণ নেওয়ার জন্য খোঁচাতে থাকে। দেশের বারোটা বাজিয়ে নিজের আখের গোছাতেই কিছু লোক এ ধরনের ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী। তিনি বলেন, যেখানে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে সেখানে নানা শর্তে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো যুক্তি নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়মানুযায়ী কাজ শুরুর আগে ক্রয় নীতিমালার (পিপিআর) আলোকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দরপত্র আহ্বান করতে হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোয় এ নীতি মানা হবে না। যেহেতু চীন থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, শর্ত মানতে এখানে চীনেরই কোনো ভুঁইফোড় কোম্পানির মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়ে তা অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে একটি শ্রেণি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবে। ঘানি টানবে সাধারণ মানুষ। এদিকে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেছেন, চীনের ঋণ প্রক্রিয়া পরিবর্তন করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। তারা বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর