শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ভারত গেলেন পঞ্চগড়ের ১০৫ জন

‘ওপারে সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

‘ওপারে সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’

পরিবার ছেড়ে নতুন দেশে যাচ্ছেন তারা। ফেলে যাচ্ছেন বহু দিনের বন্ধন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

মুক্তিযোদ্ধা হীরা মোহন রায়ের (৬২) স্ত্রী সুমিত্রা রানী রায় (৫৫) প্রিয় সন্তানদের বিদায় জানাতে গিয়ে বললেন, ‘স্বামীর সুখে আমি সুখী। মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সে। ১৬ কোটি মানুষই তার সন্তান। অভাব আছে, কিন্তু এ দেশেই অনেক শান্তিতে আছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মায়ের কাছে সন্তানরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আমার সন্তানরা ওপারে যেন দুধে ভাতে থাকে। এই আশীর্বাদ করি।’ বিলুপ্ত দইখাতা ছিটমহলের হীরা মোহন ’৭১-এ বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য যুদ্ধ করেছেন। তাই দেশের মায়া ছাড়তে পারলেন না। বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই। এ দিয়েই স্বামী-স্ত্রীর চলে যাবে। এ দেশে থেকেই বাকি জীবনটা কাটাতে চাই।’ তারই তিন ছেলেমেয়ে গতকাল ভারতে চলে গেছেন। হীরা মোহনকে ভারতে যাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েরা অনেক অনুরোধ করেছিলেন। নানা সুযোগ-সুবিধার কথাও বলেছিলেন। ‘সংখ্যালঘু হয়ে একা একা এ দেশে থাকলে কখন বিপদ-আপদ হতে পারে’- সে কথাও বলেছিলেন। আরও বলেছেন, ‘এখানে মুখাগ্নি করারও কেউ থাকবে না তার।’ তবু হীরা মোহন দেশের মায়া ছাড়েননি। বলেছেন, ‘এ দেশ ঘিরে রয়েছে হাজারো স্মৃতি। এগুলোই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। ভারতে গেলে হয়তো অনেক কিছুই পাব। কিন্ত এ দেশটা আমার নিজের। এ দেশের মাটির গন্ধে প্রতিদিন আলোড়িত হই। তাই শত কষ্ট হলেও এ দেশ ছাড়তে পারব না।’ একইভাবে এ ছিটমহলের ঠেলুরাম বর্মণ আর সুশীলা বর্মণ দুই মেয়েকে রেখেই ভারতে চলে গেছেন। তাই এ দেশে দুই মেয়ে ময়না রানী আর দীপ্ত রানীর কেউ রইল না। ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই চলে গেছেন। শুধু দুই বোন থেকে গেছেন এ দেশে। কাঁদতে কাঁদতে দীপ্ত রানী বলছিলেন, ‘কোনো দিন ভাবিনি জীবিত অবস্থায় বাবা-মাকে শেষ দেখা দেখতে হবে। আর মনে হয় মা-বাবার মুখ দেখা হবে না।’ দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল কোর্ট ভাজনীর দয়ারানী আর মায়া রানীও স্বামীদের ছেড়ে গেলেন না। ভারতে যাওয়ার জন্য ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করলেও স্বামীরা ২০১১ সালের হেড কাউন্টিংয়ে বাদ পড়েছিলেন। তাই তারা যেতে পারছেন না। স্বামীরা যেতে পারলেন না বলেই মত পাল্টে বাংলাদেশে থেকে গেলেন তারা। চতুর্থ দফায় গতকাল দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত দহলা খাগড়াবাড়ী ও বোদা উপজেলার দইখাতা ছিটমহল থেকে ভারতে গেছেন ২১ পরিবারের ১০৫ নাগরিক। এ নিয়ে পঞ্চগড়ের ৩৬ বিলুপ্ত ছিটমহল থেকে ৯৩ পরিবারের ৪৫২ জন ভারতে গেলেন। অবশিষ্ট ৩৯ জনের মধ্যে ৩৪ যাবেন ৩০ নভেম্বর। তবে তাদের মধ্যে পাঁচজন এরই মধ্যে মত পাল্টে একেবারেই ভারতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর ৩৪ জন যেতে পারলেন না যথাসময়ে সহায়সম্পদ বিক্রি করতে না পারার কারণে। সকালে দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শেষে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ গোলাম আজম ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব (ফার্স্ট সেক্রেটারি) রমাকান্ত গুপ্তের হাতে কাগজপত্র তুলে দেন। তিনটি বাস ও পাঁচটি ট্রাকে ভারতীয় এ নাগরিকরা মালামাল নিয়ে নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তের পথে রওনা দেন। এ সময় সেখানে জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়াদের অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানান স্বজনরা। এ সময় চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল তাদের বুকফাটা কান্নায়। অনেকে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেন। নীলফামারীর চিলাহাটির ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তে আবদুর রউফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুপুরের দিকে গমনকারীরা ভারতে প্রবেশ করেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ গোলাম আজম বলেন, ‘যারা সহায়সম্পদ বিক্রি করতে পারেননি, মূলত তারা এখনো যেতে পারেননি। এদের সম্পদ সরকারিভাবে জেলা প্রশাসকের নামে কেনার প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এ প্রক্রিয়া শেষ হলে তারাও চলে যেতে পারবেন।’ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘বরাদ্দ পেয়েছি। রবিবারের মধ্যে জমি নিবন্ধন করা হবে। ৩০ নভেম্বরে তারাও চলে যেতে পারবেন।’

সর্বশেষ খবর